Skip to main content

মানুষের প্রয়োজন যে শুধু ভাত-কাপড় আর আশ্রয় তা তো নয়, মানুষের আত্মসম্মানবোধ আছে। যে নীতি মানুষের আত্মসম্মানবোধের চারদিকে পাঁচিল তোলে, মানুষকে নিজের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়, সে নীতি মানুষের চিরকালের নীতি হতে পারে না। মানুষের লোভ আছে, স্বার্থপরতা আছে, ভয় আছে, ক্ষুদ্রতা আছে – এ সব আছে, কিন্তু সভ্যতার ইতিহাস মানে শুধু এইক'টাই তো নয়। মানুষের পরার্থপরতা আছে, উদারতা আছে, আত্মত্যাগ আছে, সত্যান্বেষণ আছে। যে কারণে সেদিন উচ্চারণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ – মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ।

       সেই পাপ আজ আমাদের আবার ঘিরে ধরছে। 'মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ' অর্থে এই নয় যে মানুষের সমস্ত অবগুণকে অস্বীকার করা, মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো অর্থে মানুষের মধ্যে মানুষের মহত্বের ওপর বিশ্বাস হারানো। মহাত্মা গান্ধী বলছেন, সমগ্র মনুষ্যত্ব একটা সাগরের তুল্য। তার ক্ষুদ্র একটা অংশ কখনও কখনও দূষিত হতে পারে বটে, সমগ্র সমুদ্রটা না, তাই মনুষ্যত্বের উপর বিশ্বাস হারানো যায় না।

       আজকে কথায় কথায় হার্ড ইম্যিউনিটির কথা শুনছি। গোষ্ঠী অনাক্রম্যতা। গোষ্ঠী অনাক্রম্যতাই মানুষকে রক্ষা করতে পারে, এমন কথা শোনা যাচ্ছে। এই গোষ্ঠী কথাটাকেই চিত্তের জগতে 'মনুষ্যত্ব' বলি আমরা। কোনো একজন মানুষ যখন বিশেষ কোনো ক্ষমতায় পারঙ্গম হয়, তখন তাকে আমরা প্রতিভা বলি। আর যখন কোনো একজন মানুষের মধ্যে এই গোষ্ঠীসত্তার অনুভব জাগ্রত হয় – তখন তাকে আমরা মনুষ্যত্ব বলি।

       আমাদের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি – সব কিছু যদি মানুষের এই মনুষ্যত্বের বোধকে খর্ব করে, তবে তা পাপ। কিভাবে খর্ব করে?

১) যখন মানুষ নিজের শ্রমের মর্যাদা ভুলে ‘পাইয়ে’ দেওয়ার নীতিতে অভ্যস্ত হতে চায়। রাজতন্ত্র আর গণতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য শুধু সিংহাসনের অধিকার নিয়ে নয়। অধিকারের তারতম্য নিয়েও হয়। রাজতন্ত্রে প্রজার ভালোমন্দের ভার সম্পূর্ণ রাজার উপর থাকে, গণতন্ত্রে জনগণের ভালোমন্দের ভার থাকে তার নিজের উপর। সে একজন নেতা ঠিক করে কোনো মানুষকে সামনে রেখে না, একটা আদর্শ নেতৃত্বকে সামনে রেখে। আদর্শ নেতৃত্ব তখনই সম্ভব যখন প্রতিক্ষণে সে নিজেও জাগ্রত থাকে, সচেতন থাকে নিজের বৃহত্তম স্বার্থের দিকে তাকিয়ে। মানুষের বৃহত্তম স্বার্থ তার মনুষ্যত্বের রক্ষা ব্যতীত আর কিছুই হতে পারে না। তার ভোগ, তার উচ্ছৃঙ্খলতা কোনোদিন তাকে দীর্ঘস্থায়ী মঙ্গলের দিকে নিয়ে যেতে পারে না, এ ইতিহাস সাক্ষী। কত সভ্যতা নিজের ধ্বংস নিজে ডেকে এনেছে শুধুমাত্র এই চিত্তের গোষ্ঠী অনাক্রম্যতাকে অস্বীকার করে। নিজেকে সর্বোত্তম ভেবে, নিজের ভোগকে একমাত্র পুরুষাকার ভেবে, নিজের ভবিষ্যতকে একমাত্র জীবনের লক্ষ্য করে। মানুষ একার মধ্যে একা কোনোদিন সার্থক হতে পারে না। মানুষ নিজের মধ্যে সমষ্টিকে না দেখতে পেলে সে আর যেই হোক, নেতৃত্বের আসনে বসার যোগ্য সে নয়। আজ সে বিভাজন স্পষ্ট।

২) বিভাজন - অতিমূল্যায়ন ও অবমূল্যায়নের দ্বারা---

সত্যের স্বভাবের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য থাকে। অতি ও অব – এ দুই থেকে সে নিজের অবস্থান পৃথক রাখে। সুনেতৃত্বের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল – সঠিক মূল্যায়ন। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। কোনো এক গোষ্ঠীর অতিমূল্যায়ন ও কোনো এক গোষ্ঠীর অবমূল্যায়ন যদি ক্রমাগত হতে থাকে তখন বুঝতে হবে শুধু নেতৃত্বই দোষদুষ্ট নয়, সমগ্র দেশের চেতনায় একটা অবসাদ এসেছে। জড়ত্বের অবসাদ। মানুষের ইতিহাসে এই জড়ত্বের অবসাদের গভীরতম বীজটি যা রোপণ করে তা হল 'ধর্ম'।

       ধর্ম তখন মানুষের অযৌক্তিক আকর্ষণ, অযৌক্তিক ভালোবাসা, অযৌক্তিক আস্থা, অযৌক্তিক বিবিক্ততা, অযৌক্তিক আত্মমর্যাদা, যখন ধর্ম মনুষ্যত্বের ধ্বজাধারী না হয়ে ধর্ম কোনো গোষ্ঠীর ধ্বজাধারী হয়ে ওঠে। সে তখন আত্মমোহে, আত্মমদে এমন উন্মাদ হয়ে ওঠে যে সে ভুলে যায় চিরকালের অবিনশ্বর অক্ষয় মনুষ্যত্বের সত্যধর্মেরই সে বাহক। নিজেকে ক্ষুদ্র করে, নিজেকে তীব্র উগ্র করে সে এমন তাণ্ডব ঘটাতে শুরু করে যাকে এক কথায় বলা যায় প্রলয়। তখন আসে চিত্তের অবসাদ। জড়ত্বর স্বভাব। সত্য যেখানে গ্রহণের দ্বারা আচ্ছন্ন সেখানে অবমূল্যায়ন আর অতিমূল্যায়নের খেলা চলতেই থাকে। ‘গ্ল্যাডিয়েটর’ সিনেমার কথাটা স্মরণ করাতে চাই। রাজা যখন দেখলেন সত্যধর্মে চলার ক্ষমতা তার নেই, তখন তিনি সমগ্র রাষ্ট্রে চিত্তের জাগরণের পথ রুদ্ধ করে প্রবৃত্তির লালসাকে চরিতার্থ করার দরজা খুলে দিলেন। মনুষ্য চরিত্রের দুর্বলতা সম্বন্ধে তিনি জ্ঞাত ছিলেন। মানুষ সেই প্রবৃত্তির উন্মাদনায় নিজেকে ভাসিয়ে দিল। জাগ্রত চিত্ত যে প্রশ্ন করে, উন্মত্ত প্রবৃত্তি সে প্রশ্ন করে না। সেই থেকেই জন্ম নেয় মোহ ও ভ্রান্তির রাজত্ব।

৩) মোহ ও ভ্রান্তির রাজত্ব---

মোহ সত্যকে চায় না, তথ্যকে চায়। 'পোস্ট ট্রুথ' বলে যে শব্দটা শুনি, আসলে ওটা 'পোস্ট কাস্টমাইজড ফ্যাক্টস'। সত্যকে বিকৃত করা যায় না। তথ্যকে যায়। কারণ তথ্যের একটা সংগতি ও ধারাবাহিকতা থাকে। সেই সংগতি ও ধারাবাহিকতাকে নষ্ট করে দিয়ে, কিছুদিনের জন্য একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা যায়। আজকের দিনে আমাদের নানা মিডিয়া ও নানা নেতৃত্ব যে কাজটি করে চলেছে। সংবাদের গুরুত্ব, ভাবনার গুরুত্ব, আলোচনার গুরত্ব – সত্যের হাতে না, মোহের হাতে। আমাদের ঘোর তৈরি করে দিতে হবে। আমি আরেকটা সিনেমার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই – ইনসেপশান। কোনো ধারণাকে কারোর অবচেতনের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া, তার অজান্তেই। যাতে সে তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। তার মস্তিষ্কের মধ্যে একটা স্বচ্ছ অবাস্তব অলীক রূপ যদি এঁকে দেওয়া যায় তার নিজের সম্বন্ধে, যদি বৃহৎ মনুষ্যত্বের সঙ্গে তার যোগসূত্রের কথাটা ভুলিয়ে দেওয়া যায়, তবে তাকে দিয়ে যা খুশী করিয়ে নেওয়া যেতেই পারে। তার মধ্যে যে সব উপাদানে এই ধারণা তৈরি করা যেতে পারে, তার উৎকৃষ্ট উপাদানগুলি হল – ধর্ম, সংস্কৃতি আর ভাষা। তাকে বলো, “এইগুলোতে তুমি অনন্য, বৃহৎ মনুষ্যত্ব থেকে এর মূল্য তোমার জন্য আলাদা। এই তোমার পরিচয়।“

       কিন্তু শুধু সীমা টেনে দিলে হবে না তো, চাই প্রতিপক্ষ। তাই কিছু প্রতিপক্ষ দাও দাঁড় করিয়ে। যারা হবে তার শত্রু। যারা তার মৌলিকত্ব, অস্তিত্বকে নাকি প্রতিমূহূর্তে বিপন্ন করতে চাইছে এমন গল্প শুনিয়ে দাও, বাকি কাজটা তারাই করে নেবে। এইবার সরে এসো। তোমার বারুদ ঠাসা হয়ে গেছে।

       মানুষের ব্যক্তিসত্তা আর সমষ্টিসত্তার বোধের মধ্যে যখন বিরোধ ঘটে তখন অনায়াসেই এই কাণ্ডটি ঘটানো যায়। সে যখন ভুলে যায় এই মহাসাগরের সে একটি বুদবুদ মাত্র, বুদবুদ হয়ে বা একটা দীঘি হয়ে সে আত্মগৌরবে কোনোদিন চিরপ্রতিষ্ঠ হতে পারবে না, তখন সে এমন নেতৃত্বের কথা বারবার শোনে, যে তাকে তার গুহার মুখে শিকার দিয়ে যায়। সমস্ত জঙ্গলের উপর যে তার স্বাভাবিক জন্মজাত অধিকার, তাকে ভুলিয়ে দেওয়া হয় সুচতুর কৌশলে। তার দুর্বলতাকেই তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করে।

       একদিন আমাদের কল্পনায় দেব-দেবী ছিলেন তেত্রিশ কোটি। আমরা বুঝেছিলাম কোথাও একটা সত্যের কাছাকাছি নেই আমরা। অবশেষে আমাদের ধারণায় এলেন ব্রহ্ম। যিনি সমগ্র। যাকে নানা অলৌকিক ক্ষমতা থেকে মুক্ত করে বললাম, তিনি সত্য, চেতনা ও আনন্দ। আমরা চিত্তে মুক্তি পেলাম।

       আজ আবার চিত্তে মুক্তি পাওয়ার দিন এসেছে। ব্রহ্মকে জানার মাধ্যমে না, গণকে জানার মাধ্যমে। গীতায় বলা হয়েছে সমগ্রের দৃষ্টিই যার দৃষ্টি, সমগ্রের শ্রবণ যার শ্রবণ, সমগ্রের হস্ত-পদ যার হস্ত-পদ, তাকে জানার কথা। এ তো গণ অভ্যুত্থানের কথা। এ দৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়ে কোন মধ্যযুগীয় ধর্মের দিকে আমরা চলেছি? সত্য দুই। এক লৌকিক; আর দুই, চিরন্তন। এই দুইয়ের সামঞ্জস্য যিনি ঘটান তিনি সার্থক কবি, সার্থক নেতা, সার্থক দার্শনিক। যিনি ভোলান, তিনি নন। সাধু সাবধান!

       মানুষ সত্য থেকে সত্যতর-তে যায়। ক্ষুদ্র সত্য থেকে বৃহৎ সত্যের দিকে যায়। অভিধানে তাই true, truer, truest --- এই তিনটি শব্দ পাওয়া যায়। কিন্তু false, falser, falsest --- বলে কোনো শব্দ হয় না। কারণ যা নেই আদতে, তার আর -তর/তম হয় কি করে? যা আছে তারই -তর/তম হওয়া সম্ভব। মিথ্যাকে নিয়ে ভয় নেই, ভয় হল ক্ষুদ্র সত্যকে চূড়ান্ত সত্য বলে সেখানেই বসে পড়ার সিদ্ধান্তকে। যত তাড়াতাড়ি এ ঘোর ভাঙে তত মঙ্গল।