Skip to main content

"আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, আমরা যেমন মাতৃক্রোড়ে জন্মেছি তেমনি মাতৃভাষার ক্রোড়ে আমাদের জন্ম, এই উভয় জননীই আমাদের পক্ষে সজীব ও অপরিহার্য।” ~ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
"যে ভাষায় প্রথম 'মা' বলিতে শিখিয়াছি, সে ভাষা দিয়া প্রথম 'এটা ওটা সেটা' চিনিয়াছি, যে ভাষায় প্রথমে "কেন' প্রশ্ন করিতে শিখিয়াছি, সেই ভাষার সাহায্য ভিন্ন ভাবুক, চিন্তাশীল কর্মী হইবার আশা করা আর পাগলামী করা এক। ...পরভাষায় যতবড় দখলই থাক, তাহাতে ওই চলা-বলা-খাওয়া, নিমন্ত্রণ রক্ষা, টাকা রোজগার পর্যন্ত্যই হয়, এর বেশি হয় না, হইতে পারে না।” ~ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
"মনে হচ্ছে আমরা এমন এক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, যদি কেউ ইংরাজী না জানে তবে সে আশা করতে পারে না যে সে একজন বোসের (আচার্য জগদীশ্চন্দ্র বোস) মত হবে। আমিও এর চেয়ে বড় কুসংস্কারের কথা ভাবতেই পারি না। কোনো জাপানী আমাদের মত অসহায় বোধ করে না।” ~ মহাত্মা গান্ধী


মানুষ যখন জন্মায় আলো বাতাসের মধ্যে যেমন জন্মায় তেমন একটা ভাষার মধ্যেও জন্মায়। প্রথম যে কান্নাটা সে কাঁদে, যে যে শব্দগুলো করে তা শুধু তার মা বুঝতে পারেন, কোনটা খিদের, কোনটা পেট ব্যাথার, কোনটা দুষ্টুমির। সে সম্পর্কটা একান্তই প্রাকৃতিক, জৈবিক। এরপর ধীরে ধীরে সে বলে, 'খিদে পেয়েছে'... 'তেষ্টা পেয়েছে'... 'মায়ের কাছে যাব'... কেউ বলতে পারে না, ঠিক কোন মুহুর্তটাতে সে নিজেকে প্রকাশ করার জন্য এই সঠিক শব্দগুলো নির্বাচন করতে শিখল, আর ধীরে ধীরে তাদের পাশাপাশি বসাতে শিখল। কোনো ব্যাকরণ না, কোনো পণ্ডিতমশায় না, কোনো কার্যক্রম না... তবু সে শিখতে শুরু করল। বিশাল শব্দসমুদ্র থেকে নিজের প্রয়োজনীয় শব্দগুলো চিনে নিতে শুরু করল। ধীরে ধীরে তার সম্পূর্ণ সত্তাটা সেই ভাষার সাথে একাত্ম হতে শুরু করল। একটা মানুষ মানে একটা ভাষা। একটা ভাষা মানে তার অন্তঃকরণ, তার ভাব। 
এ গেল একদিক। যত বড় হতে লাগল তত তার জৈবিক প্রয়োজন ছেড়ে বৌদ্ধিক প্রয়োজনের দিকে এগোতে শুরু করল। ভাষা শুধু প্রকাশের না, প্রয়োজনের হয়ে উঠতে লাগল। যে ভাষা দিয়ে সে বিশ্বসংসারের দিকে হাত বাড়িয়েছিল, সেই ভাষার স্রোত বেয়েই বিশ্বসংসার তার মধ্যে প্রবেশ করতে শুরু করল। সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদির মাধ্যমে সে নিজেকে একটা ধারাবাহিক স্রোতের অংশস্বরূপ বলে বোধ করতে লাগল। সে বুঝল সে আসার আগে নানান ক্ষেত্রে মানুষ তার অপরিসীম অধ্যবসায়ে নানান আবিষ্কার, উৎকর্ষতা, বাধা-বিঘ্ন নাশ করে এগিয়ে চলেছে। তার নিজেকেও এক বিন্দু জল সেই সাগরে যোগ করতে হবে। করতেই হবে। তিলমাত্র হলেও সে পথের সামনের দিকে তাকে হাঁটতে হবে, হাঁটতে না পারলেও তার পরে যারা হাঁটবে তাদের পথ পরিষ্কার করতে হবে। 
তার ভিতরের এ বোধ যে তৈরি করে দিল, সে তার মাতৃভাষা। আমাদের ক্ষেত্রে যা বাংলা। একটা ভাষা - একটা সংস্কৃতি, জীবনশৈলী, মেধা-চিন্তন-মননের ধারক-বাহক-প্রেরক। যত ভাষার গভীরে পৌঁছাই তত আমার অস্তিত্বের মূলটা গভীর থেকে গভীরতর মজ্জায় ঢুকতে শুরু করে। বহু মননের অংশীদার হই, বহু ঐতিহ্যের স্বাদ পাই। নিজেকে আবিষ্কার করি, সমাজকে আবিষ্কার করি, সময়কে আবিষ্কার করি। আমার বাংলা ভাষা বেয়েই প্রাণে বাউল আসে, কীর্তন আসে, পদাবলী আসে, ক্রমে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে বিশ্বের আঙিনায় আসা হয়। 
একটা মানুষ তথা একটা সমাজের উৎকর্ষতা তার বৈচিত্রতার মধ্যে। একদেশিতা প্রাণের স্বভাব নয়। তা যদি হত পৃথিবী জুড়ে এত বিচিত্র জীবের, এত বিচিত্র মৌলের অবস্থান হত না। মানুষের আর সমাজের প্রকৃতিতেও সেই বৈচিত্রের প্রতি সহজাকর্ষণ আছে বলেই মৌলবাদদের স্ব-অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এত ভয়ের, আতঙ্কের, লোভের সৃষ্টি করতে হয়। এক বিকারকে কায়েম করতে হাজার বিকারের শরণাপন্ন হতে হয়। তবু শেষরক্ষা হয় না বলেই অগ্রগতিটা অব্যহত রয়েছে, মাঝে মাঝে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘূর্ণাবর্ত মাথা চাঁড়া দিলেও। ঝড়টা স্বাভাবিক অবস্থা না। মৃদুমন্দ বাতাসটাই স্বাভাবিক অবস্থার লক্ষণ। ভাষার ক্ষেত্রেও তাই। মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরাজী ভাষা শেখাটা আমাদের অত্যাবশ্যক। সে ভাষাটা আজ কাজের জন্য হলেও, সারা পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ রাখতেও মোটামুটি স্বীকৃত আন্তর্জাতিক ভাষা। ইংরাজী ভাষাটা আমাদের মাতৃভাষার বিকল্প হতে পারে না, পরিপূরক হতে পারে। যে কোনো ভাষাই মাতৃভাষার পরিপূরক হতে পারে, মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে তা পরিপূরক মাত্র, বিকল্প না। কোনো কিছুর মূলটা থাকলেই ডালপালার বিকাশ ঘটে। নয় তো 'না ঘরকা, না ঘাটকা' হয়ে সংকর জীবের সৃষ্টি হতে বাধ্য, যার নিদর্শন খুব একটা দুর্লভ নয়। নিত্য-নৈমিত্তিক খাদ্য তালিকায় কিছু অভাব থাকলে বাইরে থেকে ভিটামিন খেয়ে সে অভাবটুকু পূরণ করা যায়, কিন্তু কেউ যদি নিত্য খাদ্যকে ভিটামিন দ্বারা প্রতিস্থাপিত করতে চায়, তবে তা হাস্যস্পদ শোনায়।
জলপানের একটা উদ্দেশ্য অবশ্যই তৃষ্ণা নিবারণ, কিন্তু তার সাথে সাথে সে একটা তৃপ্তিও অনুভব করে। সে তৃপ্তিটা একমাত্র মাতৃভাষাতেই সম্ভব। যদি কেউ তা অস্বীকার করেন, তবে মূলে কিছু গলদ ঘটেছে অনুমান করে নেওয়া যেতেই পারে। আমার অঞ্চলের প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত নন এমন মানুষের সাথে যে ভাষায় আত্মীয়তা গড়ে তুলতে পারি, সে নিশ্চই আমার মাতৃভাষা। আজ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যা হিন্দীভাষায় গড়তে পারি (এ নিয়ে আগে একটা প্রবন্ধ লিখেছি, তাই বিস্তারিত আলোচনা বাহুল্য। ক'দিন আগে এক সৈনিক তাদের দুর্দশা নিপীড়নের যে চিত্র সবার সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিল, তা হিন্দী ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় বললে কতটা আলোড়ন তুলত আমার সন্দেহ।)। 'গান্ধী' নামক হলিউডের সিনেমাটা যারা দেখেছেন, তাদের সেই বিখ্যাত দৃশ্যটা নিশ্চই মনে আছে, মহাত্মার প্রথম ভাষণ, তাঁর আগে যাঁরা বলেছেন বেশিরভাগই ইংরাজীতে, ইংরাজদের মতন করে। তাতে জনসাধারণের মস্তিষ্ক সাড়া দিলেও হৃদয় সাড়া দেয়নি। পৃথিবীর সব কালের সব জননেতারাই জনগণ অবধি পৌঁছাতে পেরেছিলেন, জাগাতে পেরেছিলেন মাতৃভাষাতেই। সক্রেটিস, বুদ্ধ, খ্রীষ্ট, চৈতন্য, কবীর, নানক, তুলসীদাস, রামকৃষ্ণ প্রমুখ কিংবদন্তী মহাত্মা সকল এর উজ্জ্বল উদাহরণ। মহাত্মা গান্ধী সেটা পেরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সেটাই মহাত্মা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ভারত এঁকে নিজের আত্মীয় বলে বোধ করেছিল। হৃদয়ের সাড়া একমাত্র মাতৃভাষাতেই পাওয়া যায়। জীবনের মূলসুর যে 'ওরা কাজ করে' -দের নিত্যজীবনের সুরে বাঁধা, সে সুর একমাত্র মাতৃভাষাতেই অনুভব করা যায়। জীবনটাকে ওপর ওপর ঘেরাটোপে আলো-বাতাস না লাগিয়ে মরে বেঁচে থাকার চাইতে বড় কিছু চাইলে 'নান্যপন্থা বিদ্যতে' - অন্য পথ নাই। তাতেই আমাদের নিত্যকারের জীবনযাত্রা চলে। জীবন থেকে মৃত্যু অবধি সব অভিজ্ঞতা এই ভাষাতেই অনুদিত হয়ে সাহিত্যসম্পদ হয়ে কালজয় করে। 
মাতৃভাষা আমার কোনো পছন্দ না, যেমন আকাশ-বাতাস-সময় আমার কোনো পছন্দ না, আমার পরিচয়। সে আত্মপরিচয় স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হলে সে পূর্ণ অর্থে মনুষ্যপদবাচ্য কিনা তাই যখন বিবেচ্য তখন বাকিটা আর কহতব্য না। যা সহজে পাওয়া যায় তার মূল্য বুঝতে যে বোধের প্রয়োজন শুধু নয়, আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষাও প্রবল থাকা বাঞ্ছনীয়, তবেই একটা দাদাঠাকুরের জন্ম হয়। একটা একুশে ফেব্রুয়ারী মাথা তোলে। অন্য ভাষার সাথে বৈরীতাতে গিয়ে না, স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে নিজের মাটিতে, নিজের পরিচয়ে। ভাষা একটা ইতিহাস না, ভাষা শ্বাসবায়ু, রক্ত, জ্যোতি। ভাষা একটা ঘটনা, একটা প্রবাহ। আর মাতৃভাষাটা 'আমার' না, মাতৃভাষাটাই 'আমি'।

(ফেসবুকে বহু মানুষ, কিছু গ্রুপ অসাধারণ কাজ করে আসছেন সারাটা বছর ধরে মাতৃভাষা নিয়ে। আজ এই বিশেষ দিনটাতে তাঁদের সক্কলকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা, অভিনন্দন, শুভেচ্ছা ও প্রণাম জানাই। আমার এ সরব চিন্তামালা তাঁদেরই উদ্দেশ্যে রাখলাম।)