আজ বন্ধুত্ব দিবস। জানতাম না। অনেকে বললেন বন্ধুত্ব নিয়ে কিছু লিখতে। ভাবলাম কি লিখব? বন্ধুত্ব নিয়ে কি লেখা যায়! এ তো বিশাল বড় কথা - বন্ধুত্ব।
একটা বই পড়ছিলাম ক'দিন আগে। প্রাচীন রোমান দার্শনিক সেনেকার লেখা কিছু চিঠিপত্র নিয়ে। তাতে একটা খুব মজার চিঠি আছে। একজন সেনেকাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন, নিজের কিছু ব্যক্তিগত সংশয়, সমস্যার কথা জানিয়ে, আর চিঠিটা পাঠিয়েছেন তাঁর এক বন্ধুর হাতে। তাতে আরো উল্লেখ করেছেন যে, সেনেকা যেন তাঁর পত্রবাহক বন্ধুটির সাথে চিঠির ব্যক্তিগত বিষয়গুলি আলোচনা না করেন।
সেনেকা চিঠির প্রশ্নাবলীর উত্তর দেওয়ার আগে লিখছেন, "তুমি কেমন মানুষ হে, যে চিঠি নিয়ে আসছে, তাকে বন্ধু বলছ, আবার তার সাথে তোমার ব্যক্তিগত কথা আলোচনা করতেও বারণ করছ। তুমি কি বন্ধুত্বের মানে বোঝো? যাকে নিজের মতই বিশ্বাস করা যায়, সেই বন্ধু। এ যদি না বোঝো, তা হলে সমূহ বিপদ!"
তাই তো! বন্ধুত্বের এ দাবী যে মেটাতে পারে না, তাকে সঙ্গী সাথী বলা যায়, বন্ধু বলা যায় কি!
আমাদের দেশেও বন্ধুত্ব নিয়ে বেশ সুন্দর সব লেখা আছে। যেমন তুলসীদাসজীর বিখ্যাত গ্রন্থ - 'রামচরিতমানস'-এ লিখছেন, যে সাচ্চা বন্ধু তার কতগুলি গুণাবলী থাকবে। সে নিজের সমস্যার থেকে বন্ধুর সমস্যা বড় করে দেখবে, সে বন্ধুকে কুপথে যেতে বাধা দেবে, আবার বন্ধুর দোষগুলোও সর্বসমক্ষে ঢেকে রাখবে। আর বিপদের দিনে তার পাশে থাকা, সহানুভূতি হবে চূড়ান্ত।
আর এর বিপরীত যদি হয়? অর্থাৎ মুখে মিষ্টি আর তুলসীদাসজীর বর্ণনাতে 'মনের চলন বাঁকা সাপের মত'? বলছেন তাকে তৎক্ষণাৎ ত্যাগ করো। কারণ কপট বন্ধু 'শূল বেদনার' মত হয়! কি চমৎকার উপমা!
বন্ধুত্বের মহিমা সারা পৃথিবীর সাহিত্যে মণিমুক্তার মত ছড়িয়ে। আর আমাদের জীবনে? অ্যারিস্টটল মহাশয় তো বলেই বসলেন, 'ভায়া সব ছাড়া বাঁচা যায়, কিন্তু খাঁটি বন্ধু ছাড়া প্রাণধারণ যে কি যন্ত্রণার'! সত্যিই তো তাই। অস্বীকার করি কি করে!
"আজকাল আর ভালো বন্ধু পাওয়া যায় না" - এই কথাটা আমি জন্মাবধি শুনে আসছি। এই 'আজকাল' শব্দটা বড় গোলমেলে। আমি তো এই আজকালেই বেঁচে আছি। পুরাকাল তো শুধু শুনেছি, পড়েছি। দেখিও নি, বাঁচিও নি সেকালে। তাও একালেই চারদিকে বন্ধুত্বের এত অভাবও তো দেখিনে ভায়া!
বলি কি, ভালো বন্ধুত্ব চাওয়ার আগে, নিজে ভাল বন্ধু হও দিকিনি! কার? সবার আগে নিজের। হুঁ। এই কথাটা আমার মনে বড় ধরে। গীতা বলেন, তুমিই তোমার সবচেয়ে বড় বন্ধু আবার তুমিই তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু। কি খাঁটি কথা। বুদ্ধদেবও বলেন, তুমি যদি নিজের মনকে বন্ধু বানাতে পারো, তা হলে কেল্লাফতে! ওই কাজটি সবার আগে সারো। নিজের ভিতর নিজেকে নিয়ে ক্ষোভ, অশান্তির পাহাড় আর তুলো না। বন্ধুত্ব করো। তুমি যেমন, নিজেকে সেভাবেই স্বীকার করো তো ভায়া। সব তোমার সহজ হয়ে আসবে। তখন তুমি বুঝবে কে তোমার আসল বন্ধু আর কে ভেজাল। সারাদিন খুঁতখুঁত না করে একটু চোখ মেলে চেয়েই দেখিনা। সে বন্ধু আমার পাশেই আছে, আমি একটু এগিয়ে আসলেই হবে। হবেই হবে।
আর সব শেষে বলি, অ্যামিবা থেকে মানুষ অবধি যে পরম বন্ধু হাত ধরে নিয়ে এসেছেন, তেমন ভাবে হাত বাড়ালে সে হাতের ছোঁয়া বেশ পাওয়া যায়! এ বিশ্বাস না, বিশ্বাসের উপলব্ধি!