সোশ্যাল মিডিয়া না থাকলে সত্যিই আমরা জানতাম না, আমরা এত এত বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা এত সযত্নে লালন করি গোপনে, সব শিক্ষা সুবিচার এড়িয়ে। সব চাইতে বেশি বোঝা যায় নিউজলিঙ্কগুলোর নীচে চোখ বোলালে। একটা মৃত্যুর খবর, দুর্ঘটনার খবর, ধর্ষণের খবর কি অনায়াসে হাসির খোরাক হয়, টীকাটিপ্পনীর খোরাক হয়, রাজনীতির রঙ লাগানো হয়। ধর্ম, দেশ, খেলা, রাজনীতি, সিনেমা ইত্যাদি যাই হোক না কেন, এ যেন অনন্ত বিদ্বেষ মন্থন। এত এত বিষ বছরের পর বছর বেরিয়েই যাচ্ছে, বেরিয়েই যাচ্ছে। আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী, সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব কিসের কিসের মধ্যে না এই বিষ ছড়াচ্ছে। আমি "সোশ্যাল মিডিয়া আশীর্বাদ না অভিশাপ" টাইপের কিছু বলতে চাইছি না, স্কুলে বিজ্ঞান নিয়ে যে রচনা লিখে আসছি যুগ যুগ ধরে। নিশ্চয়ই সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক ভালো কাজ হয়। আমার বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়া না, সে তো আয়না শুধু, আমি অবাক হই মানুষের নির্মম মন্তব্যগুলো পড়ে। একটা শিশুর ধর্ষণের খবরেও হাসির রিয়্যাকশান দেখি শুধু ধর্ম বা দেশের ফারাক আছে বলে। যারা সে রিয়্যাকশানগুলো দেয় তারা অনেকেই নিজেদের আসল প্রোফাইল থেকেই দেয়। কি সুন্দর ভদ্র ছবি। পারিবারিক ছবি। বেড়াতে যাওয়ার ছবি। যে ধর্মে বিশ্বাসী সেই ধর্মের নানা পোস্ট। নানা মহাপুরুষের বাণী। কি নেই তাদের টাইম লাইনে। কিন্তু কি হীন, অমানবিক মন্তব্য তারা করে যাচ্ছে বছরের পর বছর এই বিদ্বেষকে লালিত করে এত যত্নে!
আমার কি ভয় হয় জানেন? আমরা যা-ই চর্চা করি তা-ই দিন দিন সুক্ষ্ম হয়, আরো শক্তিশালী হয়। তবে আমাদের এই সোশ্যাল মিডিয়ায় নানাভাবে, নানা কৌশলে, নানা আকারে-ইঙ্গিতে করে চলা এই বিদ্বেষের চর্চা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? কোথায় নিয়ে যাবে?
আমি শিক্ষকতা করি। ক্লাস নাইন থেকে টুয়েলভ অবধি বাচ্চারা যারা কোনো না কোনোভাবে সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত আমি তাদের স্বভাবের মধ্যে একটা বিশেষ দিক দেখেছি। তারা কি ভীষণভাবে নিজেদের বায়াসনেসকে সাপোর্ট করতে শিখে যাচ্ছে। বাকচাতুরী কি সাংঘাতিক মাত্রায় বাড়ছে। কোনো বিপরীত ভাবনাকে গ্রহণ করার ক্ষমতা কমছে। আগেই প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠছে। যেন সব বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেওয়াটাই একমাত্র কর্তব্য। অথবা জাস্ট ইগনোর বা অন্য মতামতকে 'নেই' করে দেওয়া।
আমরা যেন নিজেদের অজান্তে এক ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি তৈরি করছি। সেখানে নিজেদের মত করে আগুনের ব্যবস্থা করছি। আমার আগুন, তোমার আগুন। আলাদা আলাদা করে রাখছি। যেন আমার আগুনে শুধু পুড়বে তুমি, তোমার আগুনে আমারই শুধু পোড়ার ভয়।
সারাদিন কাজের মাঝে মাঝেই নিউজে চোখ রাখা আমার স্বভাব। আজকাল যত দিন যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায় আসা কোনো নিউজ থ্রেডে কোনো সংবেদনশীল নিউজ দেখলে আমার অবচেতনে একটা ভয়, সঙ্কোচ জন্মায়। কোনো রকমে নিউজটা পড়ে বেরিয়ে যাই, যেন কোনোভাবেই কমেন্টস বক্সে আঙুল না ছোঁয়। তবু দেখি। দমে যাই। হতাশ হই। বাঁচতে গেলে কি নিজেকে এতটা স্পষ্ট মেরুকরণ করে রাখতেই হয়? এতটা একপেশে বাঁচা মননে ক্লান্তি আসে না? এত এত ঘেন্না, বিদ্বেষ, আক্রোশ নিয়ে বাঁচতে বাঁচতে হাঁফ ধরে না? নাকি বাঁচার মানেটাই বদলে যাচ্ছে ক্রমশ আমাদের।
ভালো ঘটনাও আছে। চিরটাকাল ভালো মন্দের সাম্যতে জগত সংসার। আজও তাই। কিন্তু আজকের দিনে চিন্তার কারণটা হল নিজেদের সঙ্কীর্ণতাকে নির্লজ্জের মত সামনে আনতে লজ্জা পাচ্ছি না। যে মানুষটা এইমাত্র কোনো একটা সামাজিক ভালো পোস্টে ভালো কিছু লিখে এলো, সে-ই কোনো একটা সংবেদনশীল নিউজে একটা প্রোভোকেটিভ কিছু লিখে ফেলল কয়েক মিনিটের ব্যবধানে। কারণ কি? অন্য কমেন্টসগুলোর প্রোভোকেশান?
মেরুকরণের দিকে এই প্রোভোকেশান দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমরা এক গভীর জঙ্গলের দিকে যেন হাঁটছি। সবার কাছে গুপ্ত অস্ত্র। গোটা মানব সভ্যতা যেন এক বিশাল ধ্বংসের মহড়ায় মেতে উঠেছে। আমরা কি ভয়ানক অবসেসানে ভুগছি। প্রোভোক করতে আর প্রোভোকড হওয়ার অবসেসানে।
মানুষের চিত্তে বিষ জন্মাবে। আগেও জন্মিয়েছে। কিন্তু সেই বিষকে এমন গ্লোরিফাই করে পরিবেশন করার মাধ্যম আমাদের ছিল কই? আজ আছে। তাই পসরা সাজিয়ে বসেছি। বোমাবারুদের। তাচ্ছিল্য করা, নোংরামি করা, সঙ্কীর্ণ অসভ্য ইঙ্গিত করা, অত্যন্ত নিম্নরুচির অবমাননাকর সব কিছুকে শিল্প নামে চালাতে চাইছি। নতুন নতুন নামের আড়ালে নিজেদের স্মার্ট প্রমাণ করার চেষ্টায় আছি। আদতে কি করছি? আদতে দুটোই ভাব মানুষের আছে, বিদ্বেষ আর সহিষ্ণুতা। বিদ্বেষকে আমি যে কোনো স্মার্ট নামের মোড়কেই ঢাকি, আদতে তা বিদ্বেষ। তা বিষ। আমাদের চারদিকে কোনো গুপ্ত সমিতি না, কোনো চোরাকারবারি না। খোলা বাজারে আমরা এই বিদ্বেষ আর অসহিষ্ণুতার কারবার শুরু করেছি। এর পরিণাম কি? সবাই তো জানি। সেখানেই আরো সমস্যা। তবু চুপ করে আছি।