Skip to main content
সবার উপরে মানুষ সত্য

মানুষ মানুষের চাইতে অতিরিক্ত বেশি কিছু চায়। অতিমানবিক ক্ষমতা চায়, অতিমানবিক ঈশ্বর চায়, অতিমানবিক দর্শন চায়। কিন্তু সে সবই তার বিকারের চাওয়া। কথামৃতে একটা গল্প আছে, একজন বিকারের রুগী ঘরে শুয়ে শুয়ে বলছে, “ওরে আমি এক জালা জল খাব রে, ওরে আমি বিশমণ চালের ভাত খাব রে।“ বদ্যি বাইরে দাওয়ায় হুঁকো খেতে খেতে বলছেন, “ওরে খাবি খাবি, আগে জ্বরটা সারুক।“

এই বিকারটা যখন ঘোচে তখন বুঝি যে, যা চাইছিলুম তা অতিচাওয়া ছিল। তাতে শান্তি পেতুম না। জ্বালা আরো বাড়ত। তবে মানুষের গভীরতম চাওয়া কি? সে চিরকালই মানুষকে চাওয়া। শুধু একটা জীব হিসাবে মানুষ না। যা কিছু মানবিক তাকে চাওয়া। তার ধর্ম, তার দর্শন, তার বিজ্ঞান ইত্যাদি সব কিছুই যদি এই মানবিক ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়, তবে তা লোভের সামগ্রী হয়ে ওঠে কিম্বা আতঙ্কের। তাতে স্বস্তি নেই, তৃপ্তি নেই, স্থিরতা নেই। আছে উন্মাদনা, ধ্বংসাত্মক উগ্রতা আর নিষ্ঠুরতা।
ভারতীয় দর্শনে “আত্মতত্ত্ব” হঠাৎ একদিন খুব বড় আকার ধারণ করেছিল। মানুষ যেন মানুষের চাইতে অনেক বেশি বড় এইটা বোঝাবার জন্য এমন সব তত্ত্ব, ধর্মমত, ক্রিয়াকাণ্ড বড় হয়ে উঠেছিল যে মানুষের মানবিক ধর্ম পিছিয়ে পড়তে লাগল। চাপা পড়ে গেল। যাগযজ্ঞ, আকাশ ছোঁয়া অতিমানবিক দর্শন মানুষের চিত্তকে বিবশ করে তার সাধারণ চলার শক্তিটাকে পঙ্গু করে তুলল। বুদ্ধ'র আবির্ভাব হল সেই সময়ে। তিনি মানুষকে বোঝালেন, আত্মা বলে কিছু হয় না। তুমি সর্বাঙ্গীণ একটা মানুষ। কোনো দৈবী বা ঐশী ক্ষমতার মোহে নিজের মনুষ্যত্ত্বকে জলাঞ্জলি দিও না। নিজের মধ্যে অস্বাভাবিক, অতিজাগতিক, অতিমানবিক কিছু খুঁজো না। সে তোমায় চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ করে যাবে।
বুদ্ধ মুক্তি দিলেন আমাদের মনুষ্যত্ত্বকে ‘মৈত্রী’ মন্ত্রে। জন্মালো বৌদ্ধভারত। সে স্বর্ণযুগেরও অবসান হল। সেই বুদ্ধকে কেন্দ্র করেই মানুষের অন্তরের অতিজাগতিক তথা অতিমানবিক স্পৃহা প্রতিশোধ নিতে এল তন্ত্র ইত্যাদি নানান জটিল আবর্ত পথের ঘূর্ণাবর্ত তৈরি করে।
জন্মালো ভাগবত ধর্ম। এ এক অদ্ভুত পথ রচনা করল মানুষকে তার হৃত মনুষ্যত্ত্ববোধের গৌরব বোঝাতে। সে শুরুই করল অতিজাগতিক, অতিমানবিক গল্পগাথা দিয়ে। মৎস, কূর্ম, বরাহ, নরসিংহ, বামন ইত্যাদি ক্রমে বুদ্ধ ও কৃষ্ণ। যেন ক্রমশ মানুষের অভিব্যক্তি। এদের প্রত্যেকের চরিত্র বর্ণনায় প্রধান স্থান পেলো মনুষ্যত্ত্ব। বলা হল জ্ঞান, কর্ম ইত্যাদি সব ব্যর্থ যতক্ষণ না তোমার মধ্যে ভক্তি জন্মাচ্ছে। কিরকম ভক্তি? যে ভক্তি জীবপ্রেমকে ঘিরে তৈরি হয়। কপিলমুনি তাঁর মাকে বললেন, “মন্দিরের দেবতা পূজা করে যদি তুমি বাইরে এসে জীবকে কষ্ট দাও, তবে তোমার পূণ্যকুম্ভে ছিদ্র হয় মাতঃ”। প্রহ্লাদজী তাঁর বন্ধুদের ভাগবত ধর্ম বোঝাতে গিয়ে বলছেন, “ঈশ্বরকে তুষ্ট করা কোনো কঠিন কাজ নয় আমার বন্ধুরা। তিনি প্রতিটা জীবে অধিষ্ঠান করছেন। সংসারে প্রতিটা জীবের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও প্রেমপূর্ণ হয়ে থাকাই তো শ্রেষ্ঠ ভগবতপূজা। আর এইপ্রকার আচরণে প্রভু যেরূপ সন্তুষ্ট হন, আর কোনো প্রকার সাধনে সেরূপ নন।“
শ্রীকৃষ্ণ ঠিক এই স্থানটাতে আমাদের আপনার চেয়ে আপন হয়ে উঠলেন। তাই মহাভারত ও তার মধ্যস্থ গীতা; ভাগবত ও তার মধ্যস্থ উদ্ধবগীতা থেকে শুরু করে নানান পদাবলী, কীর্ত্তন, ঠুমরী, নৃত্যের বিষয়াবলী- সবেতেই কৃষ্ণের উপস্থিতি। এমনকি গোপালভাবে একটি শিশুর মূর্তিতেও তাঁর পূজা সম্ভব। যেখানে ভগবান যেন ভক্তের চাইতে দুর্বল। এ কি করে সম্ভব – একই পুরুষের উক্তি দর্শনের গভীর তত্ত্বালোচনাতেও, আবার একই পুরুষের কীর্তি প্রেমের বৈধ-অবৈধ সীমারেখার ঊর্দ্ধে গিয়েও?!
সম্ভব। কারণ শ্রীকৃষ্ণের ধর্মে বাদ দেওয়া হয়নি কিছু। সংসার থেকে সরে আসার কথা বলা হল না। নিজেকে অতিমানবতার মোহে দেখার কথা বলা হল না। বলা হল, সবার মধ্যে নিজেকে খুঁজে নাও, নিজের মধ্যে সবাইকে খুঁজে নাও। সংসারে একটা স্বধর্ম আছে (যা অবশ্যই religion অর্থে না), তার একটা বাঁধন যেমন আছে, তার একটা মুক্তির পথও আছে। মুক্তি অর্থে পলায়ন না, মুক্তি অর্থে ভালোবাসায় সহজ করে নেওয়া। কিরকম ভালোবাসা? শর্তসাপেক্ষ না। নিঃশর্ত ভালোবাসা। এইখানে গীতা থামেন। ভাগবত শুরু হয়। গোপীপ্রেম আসে। যার মাধ্যমে আবার প্রাণে ভাবের বন্যা আনবেন মহাপ্রভু বহু শতাব্দী পরে। কেন্দ্রে থাকবেন সেই কৃষ্ণ। স্ব বিরোধী কৃষ্ণ। প্রেমিক কৃষ্ণ। দার্শনিক কৃষ্ণ।
সেই তত্ত্বে কেউ খুঁজতে বেরোলো মনের মানুষ, কেউ গভীরের ভূমাকে। কি এই ভূমা? ওই যে রবীন্দ্রনাথ যাঁর পায়ের ধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন, লোকে লোকে, কালে কালে, যুগে যুগে – "ওই মহামানব আসে..."
এই হল আসল কথা। 'ক্ষুদ্র আমি'কে হারিয়ে 'বড় আমি'র পায়ে সর্বস্ব বিকানোর কথা। এতে বড় বাধা ভয়। এতে বড় সহায় প্রেম। এই কথাটাই গোড়াতে বলছিলাম, মানুষ অবশেষে মানুষকেই চায়। মানবিক ধর্মই চায়। তাই দার্শনিক থেকে বাউল সবই শেষে এসে নানানভাবে একই কথা বলেন বা গান – "সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।" আমার ঈশ্বরকেও মানুষ হয়েই আসতে হয়। তাতেই আমরা দু'জন সার্থক।

তাই তোমার আনন্দ আমার 'পর

তুমি তাই এসেছ নীচে।
আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর,
তোমার প্রেম হত যে মিছে।
আমায় নিয়ে মেলেছ এই মেলা,
আমার হিয়ায় চলছে রসের খেলা,
মোর জীবনে বিচিত্ররূপ ধরে
তোমার ইচ্ছা তরঙ্গিছে॥
তাই তো তুমি রাজার রাজা হয়ে
তব আমার হৃদয় লাগি
ফিরছ কত মনোহরণ-বেশে
প্রভু, নিত্য আছ জাগি।
তাই তো, প্রভু, হেথায় এল নেমে,
তোমারি প্রেম ভক্তপ্রাণের প্রেমে,
মূর্তি তোমার যুগল-সম্মিলনে সেথায় পূর্ণ প্রকাশিছে॥


(এই ছবিটা পাঠিয়েছেন Saheli, আমার খুব প্রিয় বন্ধু। ছবিটার জন্য কৃতজ্ঞ আর প্রণত দুই হলাম তার কাছে।)