সৌরভ ভট্টাচার্য
4 February 2020
ওরকম তো হয়েই থাকে। এত বড় একটা আন্দোলন। এতগুলো মানুষের ভবিষ্যৎ। তার উপর এত সুক্ষ্ম রাজনৈতিক তর্ক বিতর্ক, স্লোগান। আর এসব যদি ছেড়েও দাও, ধর্ম! হুম এই হল গিয়ে কথা, ধর্ম, আমাদের ইমান, পরিচয়, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা অতীতের সেই অভ্রান্ত দিশা-পুস্তক, অলোকসামান্য মহামানবেরা। তারপর নানা শাখা-প্রশাখা, যেমন পুরোনো বটের ঝুরি, এই সব নিয়েই তো আমরা। তা এত বড় একটা কাণ্ড যেখানে, সেখানে একটা শিশুর সেই মঞ্চে ঠাণ্ডা লেগে মারা যাওয়া এমন কি একটা বড় কথা হে বাপু! তার বাবা মায়ের এই আত্মবলিদান মনে রাখবে না ইতিহাস? আরে নিশ্চয়ই রাখবে। এই তো গর্ব।
কিন্তু কোথায় যেন একটা খোঁচ। বাচ্চাটা মারাই গেল? শীতে দিনরাত মা বাবার সাথে বসে থাকতে থাকতে মারাই গেল? তার আর কোনো বিকল্পও কি ছিল, মারা না যাওয়া ছাড়া?
রাজনৈতিক সুক্ষ্ম উদ্দেশ্যর কথা থাক। ফাঁসি নিয়ে এমনভাবে একটা ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা যায়, তাও কি আগে জানতাম? উকিল আবার নাকি ব্যঙ্গ করেছে যে দেখে নিও ফাঁসি হবে না। তা ফাঁসি হলেই কি আর না হলেই কি, ক্ষণিক ভ্রমতৃপ্তি বই তো কিছু নয়।
মজার কথা হচ্ছে, আমাদের কিচ্ছু করার নেই। যে বাচ্চাটা মারা গেল, তার জন্যে হাজার একটা তত্ত্ব এদিকের হয়ে, ওদিকের হয়ে বলে গেলেও, সব শেষে জানি বাচ্চাটার মৃতদেহ মৃতই থেকে যাবে।
বিষাদ নয়। অবসাদ নয়। একটা আবছায়া মূর্তি সাথে ঘুরে ফিরে বেড়ায় যেন। বিচার বলো, সহমর্মিতা বলো, সে আমাদের সিনেমার জগতে যতটা পর্দায় ছায়া ফেলে সেভাবে কি আর বাস্তবের মাটিতে ছায়া ফেলে? ফেলে না তো। জীবন যেমন চলছে চলেই যায়। রাজনৈতিক মানুষেরা চীৎকার চেঁচামেচি করে। অভিজ্ঞতা বলে, এই তো স্বাভাবিক, এই নিয়ে এত ভাবনা চিন্তার তো কিছু নেই বাপু। তুমি বরং শিল্পে মন দাও, তোমার সুকুমারবৃত্তিগুলোকে প্রস্ফুটিত করো, ঘর গোছাও, কেউকেটা হও - একটা কিছু করো।
মনের আরেকটা দিক বলতে থাকে, কিচ্ছু কোরো না। সেদিন এক অন্তঃসত্ত্বা মহিলার পেটে লাথি মারল কলকাতার একটা হাস্পাতালের রক্ষী, সবার সামনেই। এভাবে শাস্তি হয় তো দিতেই হয় বড় একটা প্রতিষ্ঠান চালাতে গেলে। কত কত এমন রাতদিন ঘটে চলেছে।
এরকম অনেক প্রাণ নিশ্চয়ই চলে যায় বড় একটা মাঠে কবাডি খেলতে গেলে, শ্বাস আটকে। এত বড় মাঠে এতটা শ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকা কি চাট্টিখানি কথা!
মনের একটা দিক শুধু কোনো বড় খেলায় নাম লেখাতে চায় না। নিজের ছোট্টো ঘরের সামনের আকাশটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শাহীনবাগের বাচ্চাটার কথা ভাবে। যে বাচ্চাটা তুচ্ছ, যে মৃত্যুটা তুচ্ছ, সেই তুচ্ছতার কথা ভাবতে ভাবতে বুকটা ভার হয়ে আসে। আবছায়া মূর্তিটা যেন স্পষ্ট হয়ে আসে। সে আরেকটা সকালের দিকে তাকায়, যদিও জানে সব সকালই সেই এক সকালের মত। সব ঈশ্বরই হাতে টানা রিকশার মত; মাথায় হাতলটা গলিয়ে যেদিকে টানবে, ছুটবে; যা চাপিয়ে দেবে, বয়ে নিয়ে বেড়াবে। টাল সামলাতে না পারলে উল্টিয়ে বিপত্তি বাধাবে। সব মহাপুরুষেরাই অতীতে দাঁড়িয়ে থাকে তাই, সব ঈশ্বরেরাই থাকে ভবিষ্যতে। মাঝে দাঁড়িয়ে মার খায় শুধু মানুষগুলো, সাধারণ মানুষগুলো, তুচ্ছ জীবনমরণের, এলেবেলে কাজের বোকা আত্মম্ভরি মানুষগুলো।
একদিন শাহীননাগ উঠে যাবে। বাচ্চাটাকেও দুদিনেই ভুলে যাবে সবাই, ইতিমধ্যে অনেকেই ভুলে গেছে যেমন, শুধু সভ্যতার অবচেতন বলে যদি কিছু থাকে, সে সেই আবছায়া মূর্তির মত সমাজের সাথে সাথে হাঁটবে আর বলবে, হিসাব মিলাও… হিসাব মিলাও।