কি অক্ষয় হবে? আজ অবধি কি অক্ষয় হয়েছে? কিছু না। এই সত্য - কিছু অক্ষয় হয়নি। না রামের রাজত্ব, না কৃষ্ণের বৃন্দাবন। অক্ষয় হয়েছে কি? না ধর্ম, না সম্পদ। না পুণ্য, না সঞ্চয়। না স্বাস্থ্য, না সুখ। শুধু বাসনাটুকু অক্ষয় থেকে গেছে, সব কিছু হোক অক্ষয়।
তবু অক্ষয়ত্ব চাই। প্রার্থনা, তপস্যা, কান্না, কত কি উঠল। কিন্তু কিছুই অক্ষয় হল না। রামকৃষ্ণদেব গল্প বলছেন,
"একজন লোকের পাহাড়ের উপর একখানা ঘর ছিল। কুঁড়েঘর। অনেক মেহনত করে ঘরখানি করেছিল। কিছুদিন পরে একদিন ভারী ঝড় এল। কুঁড়েঘর টলটল করতে লাগল। তখন ঘর রক্ষার জন্য সে ভারী চিন্তিত হল। বললে, হে পবনদেব, দেখো ঘরটি ভেঙো না বাবা! পবনদেব কিন্তু শুনছেন না। ঘর মড়মড় করতে লাগল; তখন লোকটা একটা ফিকির ঠাওরালে; — তার মনে পড়ল যে, হনুমান পবনের ছেলে। যাই মনে পড়া অমনি ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল — বাবা! ঘর ভেঙো না, হনুমানের ঘর, দোহাই তোমার। ঘর তবুও মড়মড় করে। কেবা তার কথা শুনে। অনেকবার 'হনুমানের ঘর' 'হনুমানের ঘর' করার পরে দেখলে যে কিছুই হল না। তখন বলতে লাগল, বাবা 'লক্ষণের ঘর!''লক্ষণের ঘর!' তাতেও হল না। তখন বলে বাবা, 'রামের ঘর!' 'রামের ঘর!' দেখো বাবা ভেঙো না, দোহাই তোমার। তাতেও কিছু হল না, ঘর মড়মড় করে ভাঙতে আরম্ভ হল। তখন প্রাণ বাঁচাতে হবে, লোকটা ঘর থেকে বেরিয়ে আসবার সময় বলছে — যা শালার ঘর!"
সব ক্ষয়ে যাওয়ার ভয়। অক্ষয়ের বাসনায় ভয়। ভয় থেকে হিংসা, নিষ্ঠুরতা, অশান্তি, ঈর্ষা। শান্তি নেই। শান্তি কই? রামকৃষ্ণদেব আবার গল্প বলছেন,
“শ্রীমদ্ভাগবতে আছে যে, অবধূত চব্বিশ গুরুর মধ্যে চিলকে একটি গুরু করেছিলেন। এক জায়গায় জেলেরা মাছ ধরছিল, একটি চিল এসে মাছ ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। কিন্তু মাছ দেখে পেছনে পেছনে প্রায় এক হাজার কাক চিলকে তাড়া করে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে কা কা করে বড় গোলমাল করতে লাগল। মাছ নিয়ে চিল যেদিকে যায়, কাকগুলোও তাড়া করে সেইদিকে যেতে লাগল। দক্ষিণদিকে চিলটা গেল, কাকগুলোও সেইদিকে গেল; আবার উত্তরদিকে যখন সে গেল, ওরাও সেইদিকে গেল। এইরূপে পূর্বদিকে ও পশ্চিমদিকে চিল ঘুরতে লাগল। শেষে ব্যতি ব্যস্ত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে মাছটা তার কাছ থেকে পড়ে গেল। তখন কাকগুলো চিলকে ছেড়ে মাছের দিকে গেল। চিল তখন নিশ্চিন্ত হয়ে একটা গাছের ডালের উপর গিয়ে বসল। বসে ভাবতে লাগল — ওই মাছটা যত গোল করেছিল। এখন মাছ কাছে নাই, আমি নিশ্চিন্ত হলুম।"
তবে অক্ষয় কি হবে? কিচ্ছু না। সব যাবে। সময়ের অপেক্ষা শুধু।
কিন্তু এ তো ভয়ের কথা। এতে শান্তি কই?
শান্তি নেই। শান্তি কি অভিজ্ঞতা? এই যে ছুটে ছুটে যাওয়া শান্তির খোঁজে। আসলে কি সে শান্তি? না গোলমালের ক্ষণিক বিরতি। বিরতি মানে কি শান্তি?
তবে শান্তি কি? শান্তি মানে যেখানে দ্বন্দ্ব নেই। দ্বন্দ্বহীন অস্তিত্ব কি সম্ভব? সংঘাতহীন মন কিরকম? মন মানেই তো স্ববিরোধ। স্ববিরোধী যা, সে কখনও শান্ত হয়কি? সে কোনো একটা চুক্তিতে কিছুদিন চুপ থাকে। আবার সাম্য বিগড়ায়, আবার শুরু হয় বিরোধ। বিরোধহীন মন হয় না। বিরোধকে বুঝতে বুঝতে মানুষ বিরোধের পারে যায়। তাই আমি কি জানি, আমার কি অভিজ্ঞতা, আমার কি উপলব্ধি এসব কিছুতেই কিছু আসে যায় না। প্রশ্নটা হল, আমাকে আমি কতটা বুঝি? আমার মধ্যে ওঠা হাজার একটা স্ববিরোধীভাবের মনকে আমি কতটা নির্মোহভাবে দেখতে পারি। যতটা দেখতে পাই, ততটাতেই শান্তি। খাঁটি শান্তি। কারণ তখন আমার হাতে আর কোনো বিকল্প নেই। বিকল্প মানেই ভ্রান্তি। ভ্রান্তি মানেই অশান্তি। অক্ষয় অশান্তি।