সে জায়গাটায় নিজেকে আসতে দাও, যখন মনে হবে, নাহ্, এ মানুষটা আর যা হোক, আমায় ঠকাবে না।
মানুষের যতগুলো তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়, তার মধ্যে একটা অন্যতম তিক্ত অভিজ্ঞতা হল, যখন সে বুঝতে পারে সে ইউজড হয়েছে। এই ইউজড হওয়াটাকে অনেক ভাষায়, অনেক আঙ্গিকে বলা যেতে পারে। কিন্তু মোদ্দা কথাটা হল, ঠকে যাওয়া। ইউজড হওয়া।
কারোর সঙ্গে আমার সময় কাটে, আর কারোর সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য আমি সময় তৈরি করে নিই। এ দুটোতেই সম্পর্কের মূল সুরটা বাঁধা থাকে। যখন আমি কারোর জন্য সময় তৈরি করি তখন সেখানে আমার একটা প্রত্যাশা জন্মায়। সে প্রত্যাশা নির্ভর করে আমি কার জন্য কতটা সময় তৈরি করছি। যখন জীবনের সব সময়টুকু দেওয়ার জন্য সময় বুনতে থাকি, তখন প্রত্যাশা হয় অনেক গভীর। বাসনার প্রত্যাশা নয়। তাকে ছাপিয়ে একটা মানবিক প্রত্যাশা। সে আমার সঙ্গে সম্পর্কে স্বচ্ছ হবে। আমায় ঠকাবে না। ব্যবহার করবে না। এ আমাদের এক প্রাথমিক দাবী - স্বচ্ছতা। বিচ্ছেদ অত যন্ত্রণার নয়, যতটা অস্বচ্ছতার সংশয়ে বেঁচে থাকার। আমি যখন জানি মানুষটা স্বচ্ছ নয়, তখন ভালোবাসা এক বিড়ম্বনা।
অস্বচ্ছতাকে স্বীকার করে নেওয়া ঘৃণ্য দুর্বলতা। দিনের পর দিন নিজের প্রাথমিক অধিকারটুকু থেকে নিজেকে বঞ্চিত হতে দেওয়া কোনো সম্পর্কে, নিজেকে চূড়ান্ত অপমান করা। ক্রমে নিজের উপর নিজের শ্রদ্ধা বিশ্বাস সব যেতে শুরু করে। আশপাশের উপর সন্দিহান হয়ে উঠি। কথায় কথায় অভিমান, অভিযোগের গুদামঘর হয়ে উঠি। সবাইকে অভিযুক্ত করি। অথচ মনে থাকে না যে এ সবই শুরু করেছি আমি, নিজেকে অপমানিত হতে দিয়ে। একটা অস্বচ্ছ সম্পর্কের জালে নিজেকে জড়িয়ে। দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিয়ে।
মানুষ ঠকে। রাতদিন ঠকে। জিনিসে ঠকে, দামে ঠকে, অফিসকাছারি-নার্সিংহোম-স্কুলে ঠকে, সাইবার ক্রাইমে ঠকে, রাজনীতিতে ঠকে, খেলায় ঠকে, প্রতিবেশীর কাছে ঠকে, পারিবারিক নানা সম্পর্কে ঠকে, বন্ধুদের কাছে ঠকে…. এ চলতেই থাকে। কিন্তু সে তাকে অতটা বিপর্যস্ত করে না, যতটা তাকে তার ভালোবাসায় ঠকে যাওয়া করে। প্রয়োজনের জগতে ঠকে যাওয়া, যে সম্পর্ক আমি নিজের হাতে গড়িনি, সেই সম্পর্কে ঠকে যাওয়া, মেনে নেয় মানুষ। কষ্ট হলেও। কিন্তু যেখানে সে সব চাইতে উন্মুক্ত, ডিফেন্সহীন, সেইখানে ঠকে যাওয়টা তাকে পেড়ে ফেলে। কারণ এখানে তার বিশ্বাস হেরে যায়নি শুধু, এখানে তার ভরসা হারিয়ে গেছে। বিশ্বাস হারালে দাঁড়ানো যায় আবার, কিন্তু ভরসার জায়গা, যা নিজের হাতে বানানো, নিজের হাতে গড়া, সেটা হারালে মানুষ প্রকারান্তরে নিজেকেই দায়ী করে। নিজের উপর আস্থা, বিশ্বাস, ভরসা হারিয়ে ফেলে। সে অবস্থায় নিজেকে আবার গুছিয়ে দাঁড় করানো অবশ্যই একটা চ্যালেঞ্জ। কেউ পারে, কেউ পারে না।
যে সম্পর্কের ভাঙন নিজের উপর নিজের ভরসাকে বিপন্ন করে তোলে সে ভাঙন সব চাইতে বিপজ্জনক, এ বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সে কি একদিনে হয়ে যায়? না। মানুষ অন্যের উপর ভরসা এক লহমায় হারাতে পারে। কিন্তু নিজের উপর ভরসা তিলে তিলে নষ্ট করে। অনেক ইঙ্গিতকে, লক্ষণকে অস্বীকার করে, স্বেচ্ছায় আরোপিত অন্ধত্বে। সে প্রথমে পাত্তা দেয় না, তুচ্ছ মনে করে। কারণ সে তার ভরসার সুখটা থেকে নিজেকে বঞ্চিত দেখতে চায় না। সে ভরসার মানুষটার সব অযোগ্যতার উদাহরণগুলোকে উড়িয়ে দেয়। ভাবে অবশেষে তার সাধই জিতে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।
আদতে ঠিক হয় না। যখন সবটা ভেঙে পড়ে তখন প্রথমে প্রচণ্ড আকস্মিকতায় কিছু স্পষ্ট বোঝা যায় না। ধীরে ধীরে তার স্মরণে সব আসে কিভাবে সে নিজেকে প্রতারিত করেছে। নিজেকে ঠকিয়েছে। নিজেকে নিজেই ইউজ করেছে। নিজের উপর শ্রদ্ধা বিশ্বাস ভরসা তখন তলানিতে এসে ঠেকে। বাইরে থেকে সাহায্য এলেও তাকে ভরসা করার মত মানসিক অবস্থাও সে জুটিয়ে উঠতে পারে না। হারিয়ে যেতে শুরু করে। বারবার নিজেকে সব কিছুর জন্য দোষারোপ করে, দায়ী করে। বারবার আত্মবিশ্লেষণে মন তিক্ত, রুক্ষ, রুগ্ন হয়ে পড়ে। যেন বারবার নিজেকে খুঁড়ে দেখলেই সব সমস্যার হাল সে পেয়ে যাবে এমন একটা অবাস্তব ঘোরে বাঁচতে শুরু করে। এ আরো অন্ধকার। আরো গভীর অন্ধকার।
যদি এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, তবে নিজের ভুলগুলোকে শুধু নিজের ভুল বলেই মেনে নিয়ে, স্বীকার করে আবার উঠে দাঁড়াতে পারে। ভুল হয়। এ স্বাভাবিক। কিন্তু ভুলকে চুলচেরা বিশ্লেষণে বা ভুলকে ক্রাইম বানিয়ে, এর কোনোটাতেই রাস্তা পাওয়া যায় না। ভুলটাকে ভুল জেনে এগিয়ে যাওয়াটাই মন্দের ভালো।
আর সব চাইতে ভালো? অমন অস্বচ্ছ, ঘোর তৈরি করা সম্পর্ক থেকে সময় থাকতে বেরিয়ে আসা। সংসারে সব ক্ষতিরই ক্ষতিপূরণ কিছু না কিছুভাবে হয়েই যায়, কিন্তু নিজের উপর নিজের শ্রদ্ধা-ভরসা হারানোর মত দৈন্য যে কি করুণ অবস্থায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায়, তার ক্ষতিপূরণ হয় না। ক্ষত থেকেই যায়।
তপ্ত বালি বরং ভালো, পিচ্ছিল শ্যাওলার চাইতে।