প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য দর্শনের খোঁজের মধ্যে একটা সুক্ষ্ম পার্থক্য আছে। একজনের খোঁজ শান্তির। একজনের খোঁজ সুখের। সুখ আহরণের বস্তু। শান্তি অর্জনের। সুখ মানসিক, পারিপার্শ্বিক, সামাজিক পরিস্থিতির জটিল সমীকরণের উপর নির্ভর করে। শান্তি নির্ভর করে বোধের উপর। ত্যাগের উপর।
আমি সুখ অহর্নিশি চাই। কিন্তু শান্তি আমি কদাচিৎ চাই। আমি সুখকে ঘিরে শান্তির সাম্রাজ্য চাই। কিন্তু শান্তির ভিত্তিতে সুখকে প্রতিষ্ঠা দিতে চাই না। কারণ শান্তির দাবী এক। সুখের দাবী অনেক।
সক্রেটিস বললেন, সুখ সদগুণের অনুশীলনে। অ্যারিস্টটল বললেন, দুই চূড়ার মধ্যবর্তীতে, 'দ্য গোল্ডেন মিন' অর্থাৎ ওই বাংলা প্রবাদের মতো --- 'অতি বাড় বেড়ো না ঝড়ে পড়ে যাবে, অতি ছোট হয়ো না ছাগলে মুড়ে খাবে'। জন লক প্রমুখেরা সুখের আরো নানাবিধ তত্ত্ব দিলেন। সুখ যুক্তি অনুগামী হবে, বুদ্ধি অনুগামী হবে, নীতি অনুগামী হবে। নীতি আবার অনুভবজাত, নাকি যুক্তিবিচারজাত সে নিয়েও অনেক দ্বন্দ্ব আছে। পাশ্চাত্যে সুখের খোঁজের অন্যতম আধুনিকতম বই হয় তো বা রাসেলের "কনকুয়েস্ট অব হ্যাপিনেস", সেখানে তিনি সব শেষে বলছেন জীবনটাকে বিলিয়ার্ড বোর্ড না করে ফেলার জন্য। ক্রমাগত সংঘর্ষ, নিজের মধ্যে দ্বন্দ্বের শতধা, এতে সুখ পাওয়া যায় না।
সে অর্থে আব্রাহামিক ধর্মগুলোতে শান্তির কথা থাকলেও, সেই যে প্রধান ভাব তেমন নয়। সেখানে মুক্তি, স্বর্গীয় সুখ, পরকালের প্রতিশ্রুতি এবং সেখানে সুখময় জীবনের কথা বারবার এসেছে।
হিন্দুধর্মেও সে প্রসঙ্গ আছে। কিন্তু একই সঙ্গে পাশাপাশি স্বর্গ, পরকালের প্রতিশ্রুতি ইত্যাদির নিন্দাও আছে। এমনকি কোনো পুণ্যবশে স্বর্গপ্রাপ্তি হলেও সেও যে ক্ষণস্থায়ী সে ভাবনাও বলা হচ্ছে।
"বিবেকবর্জিত লোকেরাই বেদের পুষ্পিত বাক্যে আসক্ত হয়ে স্বর্গসুখ ভোগ, উচ্চকুলে জন্ম, ক্ষমতা লাভ আদি সকাম কর্মকেই জীবনের চরম উদ্দেশ্য বলে মনে করে। ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ ও ঐশ্বর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তারা বলে যে, তার ঊর্ধ্বে আর কিছুই নেই।" [গীতা ২ || ৪২ - ৪৩]
তবে স্থায়ী কি? যতক্ষণ না মন সাম্যে স্থিত হচ্ছে। তার জন্য পরকালের অপেক্ষা না করে এখনই করা উচিৎ ও কর্তব্যও। গীতার এই দর্শন। গীতাতে আত্মার শ্রেষ্ঠতম গতি যা বলা হচ্ছে সেখানে শুধু সাম্য প্রতিষ্ঠা, শান্তির কথা বলা হচ্ছে। এমনকি যে স্থিতপ্রজ্ঞতার কথা বলা হচ্ছে, যা গীতায় মানুষের চিত্তের শ্রেষ্ঠতম অবস্থান সেখানেও শান্তিই প্রধান সুর।
"যাঁদের মন সাম্যে অবস্থিত হয়েছে, তাঁরা ইহলোকেই জন্ম ও মৃত্যুর সংসার জয় করেছেন। তাঁরা ব্রহ্মের মতো নির্দোষ, তাই তাঁরা ব্রহ্মেই অবস্থিত হয়ে আছেন।" [গীতা ৫ ||১৯]
এ ছাড়াও গীতাতে ভক্তি, জ্ঞান ও কর্মে সাধকের মূল লক্ষ্য বর্ণনা করতে গিয়ে বারবার এই সাম্যাবস্থার কথা এসেছে। স্বামী বিবেকানন্দও নিজেকে এই সাম্য দর্শনের অনুরাগী বলছেন।
বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্মের পথেরও মূল উদ্দিষ্ট লক্ষ্য শান্তি। সুখ নয়। আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি কিনা, তার সঙ্গে আমার জীবনের মূল উদ্দেশ্যের কোনো ভিত্তিগত পার্থক্য নেই। আমি শান্তির খোঁজ করছি কিনা, এই মূল কথা। ভারতীয় দর্শনে এ সত্য বারবার প্রচারিত হয়েছে। আধুনিককালে রামকৃষ্ণদেব বলছেন, তাঁর দিকে যত এগোবে তত শান্তি পাবে।
এইবার কথাটাকে বিপরীত দিক থেকে ভাবা যাক। আমার মনে যদি হিংসা থাকে, লোভ থাকে, ঈর্ষা থাকে, নানাবিধ কুটিলতা থাকে, কোনোভাবে কি আমি শান্তিতে অবস্থান করব?
গীতার পরেই আরেকটি বইয়ের নাম উল্লেখ্য যেখানে বেদান্তদর্শনের অপরূপ ব্যাখ্যা আছে, সে হল 'বিবেকচূড়ামণি'। সেখানে বলা হচ্ছে, যদি তোমার মুক্তির ইচ্ছা থাকে, তবে সন্তোষ, দয়া, ক্ষমা, সারল্য, শম ও দমকে অমৃতের মত আদরে গ্রহণ করো।
তবে আমার নীতি স্থির করতে যদি শান্তি মাপকাঠি হয়ে থাকে তবে আমার পক্ষে নীতি নির্ধারণ করা এমন কিছু কঠিন না। কিন্তু আমার নীতি নির্ধারণের পরাকাষ্ঠা যদি সুখ হয়ে থাকে তবে আমার পক্ষে নীতি স্থির করা ভীষণ কঠিন। কিসে আমার সুখ সে অধ্রুব। কিন্তু কিসে আমার শান্তি, সে সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য। আমার নিজের নানাবিধ প্রবৃত্তিকে শান্ত করে আমার বোধবুদ্ধির সেই শান্তিময় অবস্থানের জন্য আমাকে চেষ্টা করতে হবে, সেই আমার সাধন। "যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি" --- রবীন্দ্রনাথ গাইছেন। অর্থাৎ শান্তি পেতে গেলে বিশ্বের কেন্দ্রের সেই ধ্রুবপদের সঙ্গে আমাকে যুক্ত হতে হবে। আমাকে লাভে-ক্ষতিতে-হার-জিতে-শোক-সুখে শান্ত থাকতে হবে। সহজ নয়। তাই এ সাধনা। তাই এ তপস্যা। গীতা ১৭নং অধ্যায়ের, ১৪/১৫/১৬ শ্লোকেতে তপস্যার কথা বলতে এই শান্তিতে অবস্থানের কথাই বলছেন।
পাশ্চাত্যে কান্টের দর্শনের ক্যাটাগরিকাল ইম্পারেটিভ খানিকটা এই "যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি"-র কথাই বলে। 'মানুষই যেখানে মানুষের মূল লক্ষ্য' বলা হচ্ছে। মানুষ যেন উপায় না হয়, উদ্দেশ্যই হয়।
শান্তি তর্কের দ্বারা লভ্য নয়। শান্তি যুক্তির দ্বারা লভ্য নয়। শান্তি আত্ম-অভিনিবেশ দ্বারা লভ্য। শান্তির অন্টোলজিক্যাল ব্যাখ্যা হয় না। কিন্তু নানাবিধ আপাত অগভীর নীতির অ্যাগনটোলজিক্যাল খোঁজ দরকার। জ্ঞান কি, এ প্রশ্ন যতটা দরকারী, যা নিয়ে পাশ্চাত্য দর্শন যতটা ভেবেছে, অজ্ঞান কি তা নিয়ে ভাবেনি। অজ্ঞানের কথা বারবার এসেছে প্রাচ্য দর্শনে। অজ্ঞান তা-ই যা আমাকে আমার এই শান্তির পথ থেকে বিচ্যুত করে।
"অমানিত্ব, দম্ভশূন্যতা, অহিংসা, সহিষ্ণুতা, সরলতা, সদগুরুর সেবা, শৌচ, সৈর্য, আত্মসংযম, ইন্দ্রিয়-বিষয়ে বৈরাগ্য, অহঙ্কারশূন্যতা, জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধি-দুঃখ আদির দোষ দর্শন, স্ত্রী-পুত্রাদিতে আসক্তিশূন্যতা, স্ত্রী-পুত্রাদির সুখ-দুঃখে ঔদাসীন্য, সর্বদা সমচিত্তত্ব, আমার প্রতি অনন্যা ও অব্যভিচারিণী ভক্তি, নির্জন স্থানপ্রিয়তা, জনাকীর্ণ স্থানে অরুচি, অধ্যাত্ম জ্ঞানে নিত্যত্ববুদ্ধি এবং তত্ত্বজ্ঞানের প্রয়োজন অনুসন্ধান-এই সমস্ত জ্ঞান বলে কথিত হয় এবং এর বিপরীত যা কিছু তা সবই অজ্ঞান।" [গীতা ১৩ || ৭ ~ ১১]
আজকের এই ভয়ংকরভাবে আলোকিত অন্ধকার যুগে, এই উচ্চকিত অস্থিরতা, অহমের আস্ফালনের যুগে নীতি কি স্থির করা জটিল। আইন স্থির করা অনেক সহজ বরং। তার জন্য নানা প্রকারের নিয়ম বিধি আছে। কিন্তু একা মানুষ যেখানে নানাবিধ চিন্তার বিক্ষেপে দিকনির্ণয়ে অসমর্থ হচ্ছে বারবার, আমার মনে হয় ভারতীয় বেদান্ত দর্শনের সেখানে একটা বড় কথা বলা আছে। শান্তির খোঁজ শুরু হোক। কিসে সুখ, এ প্রশ্ন না, কিসে শান্তি, এর অন্বেষণ হোক।
শান্তি কোনোদিন সাম্য, অহিংসা, উদারতা, পৈশুন্যহীনতা, গ্রহনীয়তা ছাড়া আসা সম্ভব নয়। তখন আলাদা করে কোনো নীতির অনুশীলন করতে হবে না। শান্তির তৃষ্ণাই সেই সবের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাবে যা আজকের মানবসভ্যতার টিকে থাকার জন্য বিকল্পহীন।
যা কিছু লিখলাম, এখানে নতুন কথা একটাও নেই। প্রচলিত কথায় যখন বলি, 'সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল', তখন গোটা দর্শনটাকেই লোকায়তভাবে বলি।
আরও কেন এ কথা পুরোনো নয়, কলকাতা থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে আজ থেকে মাত্র কয়েক দশক আগে রবীন্দ্রনাথ যে চেষ্টাটা, আরও ভালো শব্দার্থে বললে যে 'সাধনা'কে সফল করে তুলেছিলেন, গোটা বিশ্বকে যে শান্তির নীড়ে দেখতে চেয়েছিলেন সে শান্তি শুধু মাধুর্য নয়, অপরিসীম শক্তির একটি মানবিক অবস্থান।
(ছবি - অন্তর্জাল)