আত্মবিশ্বাস ও ভাষা
================
আত্মবিশ্বাস হারাতে শুরু করলে মানুষ নিজের সাথে সাথে নিজের বলতে যা কিছু তার উপর জোরও হারাতে থাকে। আমাদের ভাষার জোর যে কাজের ক্ষেত্রে অনেক কমে এসেছে তার কারণ এই নয় যে আমাদের পরিভাষা নেই, কারণ এই যে আমাদের পরিভাষা বানানোর তাগিদ নেই। তার ব্যবহারের দরকার নেই। আমাদের এ আত্মবিশ্বাসহীনতার জেরেই হয়ত আমরা বহু বছর হল মৌলিক চিন্তার জগতেও বিশেষ কোনো স্থান করে নিতে পারিনি। অমর্ত্য সেনের মত মানুষেরা বিশ্বজনীন চিন্তার কাজগুলো ইংরাজিতেই করেন আর ইংরাজিতেই লেখেন, তারপর সেগুলো খুব খারাপ, প্রায় অপাঠ্য অনুবাদ বাজারে চলতে থাকে।
মহাত্মাজি তার আত্মজীবনীটা পর্যন্ত গুজরাটিতে লিখেছিলেন। আরো অনেক লেখা ওনার গুজরাটিতে আছে। হিন্দীতে আছে। যখনই ইংরাজিতে বলার দরকার হত, এক প্রকার ক্ষমা চেয়ে কাজটা শুরু করতেন। ওনার ইচ্ছা ছিল ভারতের প্রতিটা আঞ্চলিক ভাষা আরো সবল হয়ে উঠুক, মৌলিক কাজগুলো আরো বেশি করে নিজের নিজের ভাষায় হোক। ভায়োলেন্স শব্দটার যথার্থ বাংলা করা শক্ত। একটা সুক্ষ্ম ভায়োলেন্স অবশ্যই ভাষার সংঘাত।
ভাষা ও ভায়োলেন্স
================
একটা দেশে অনেক ভাষা। উন্নত ভাষা, ধনীর ভাষা। রঙ্গনাথানন্দজী একটা ঘরোয়া মিটিং-এ ইংরাজিতে কথা বলছেন। হঠাৎ ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বলতে শুরু করলেন। কেন? কারণ যে জল দিতে এসেছিল সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। একজন মানুষের বহুভাষী হওয়াটা গুণের। কিন্তু সেই ভাষার প্রধান যে সুর সেটা মাতৃভাষা না হলে সেটা নিজের সাথে নিজের ভায়োলেন্স। 'আমি' মানে শুধু একটা শরীর তো নই, একটা স্রোতের একটা ক্ষণিক বুদবুদ, এটা কাব্য না, এটা সত্য। আমার বাড়িতে প্রতিটা কথায় যদি ইংরাজি শব্দের ব্যবহার হয় সেটা আমার কাজের লোকের সাথে ভায়োলেন্স। তাকে না বুঝতে দেওয়ার কৌশল, তাকে অপমান করা। রাশিয়ার সাহিত্যে পড়েছি, একটা সময় তারা উন্নত আলোচনা ফরাসী ছাড়া করতেন না, কাজের লোকের সামনেও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ফরাসীতে করতেন। এটা ভায়োলেন্স। বরং তার বেরিয়ে যাওয়া অবধি অপেক্ষা করা অনেক সম্মানের। অন্যের মান রাখলে নিজের মান থাকে - এটা আদিম নীতি।
ভাষা ও শ্রেণী
===========
তুমি অশিক্ষিত। কারণ তুমি বাংলা ছাড়া বোঝো না। এ মানসিকতা সারা ভারতে নিজের নিজের ভাষা নিয়ে। এটাও ভায়োলেন্স। একটা ভাষার জন্য নিজেকে উচ্চমার্গীয় মনে করার যে ইগো, সেও ভায়োলেন্স। এক সময় আমাদের দেশের মুনিঋষিরা যখন তারা এত বড়লোক হয়ে উঠতে পারেননি, তখন সাধারণের থেকে সাধারণ জীবনযাত্রার মানের মধ্যে আদর্শের সার্থকতা খুঁজে পেতেন। তারা গ্রাম্য সরল ভাষায় কথা বলতেন। এখন তারা নেই। এখন ভারতের ভাষার সাথে সাথে শ্রেণীর পার্থক্য যেমন বেড়েছে তেমন আধ্যাত্মবাদের সংজ্ঞাও বদলেছে। আগে ছিল আদর্শ, নীতির আলোচনা। এখন সব গুরুরা স্ট্রেস রিলিজ ম্যানেজমেন্টে ঈশ্বরের সাথে পরলৌকিক চুক্তিতে নেমেছেন। তাই ভাষা এখন ইংরাজি। আরাম এখন কম্ফোর্ট। সাধনা এখন রিল্যাক্সিং এলিমেন্ট। হঠাৎ গুরুদের কথা বললাম কেন? কারণ গুরুরাই ছিলেন ভারতীয় সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ। আমাদের সমাজ সংস্কার থেকে শুরু করে রাজনীতি --- সব কিছুই ধর্মনীতির মাধ্যমে দেখার চল ছিল। সেইখানে শ্রেণী বিভাজন হয়ে পড়া মানে সেটা একটা বড় লক্ষণ আমাদের পরিবর্তনটা অনেক গভীরের।
ভাষা ও পরিভাষা
===============
অ্যান্টিবডি কাকে বলে? না, শরীরে অ্যান্টিজেন ঢুকলে শরীর তার থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য যা উৎপন্ন করে তাকে অ্যান্টিবডি বলে। পরিভাষা আমাদের সেই অ্যান্টিবডি। সে প্রতিক্রিয়া। তাই তার মানে আছে, মান নেই। শরীরের সেই প্রবিষ্ট বস্তুটি যদি শরীরের পক্ষে আপাত হানিকারক মনে না হয় তবে কোনো অ্যান্টিবডির দরকার নেই।
ইংরাজি আর হিন্দী আমাদের প্রতিপক্ষ না, আমাদের পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন, হৃদয়ে বলিউড আর মাথায় হলিউড। এই আমাদের মোটামুটি সামাজিক অবস্থান। সুনীলবাবু যখন তার বেকার জীবনে বছরখানেকের জন্য বিদেশ গিয়েছিলেন, তখন সেখানকার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি ছেড়ে বারবার দেশে ফেরার তাগিদ অনুভব করছেন, কারণ আর কিছুই না, নিজের দেশ, ব্যস। সেখানে চাকরি নেই, কোনো উজ্জ্বল ভবিষ্যত নেই ইত্যাদি তো আছেই। তাও সুনীলবাবু ভাবছেন, আজ যদি আমি বিদেশে থেকে যাই, তবে কয়েক বছর পর দুটো গাড়ি হবে, নিজের বাড়ি হবে, মেম কি ভারতীয় বউ হবে, বাংলা না জানা দুটো ছেলেমেয়ে হবে। তারপর পূজোর সময় কয়েকটা সস্তা টেপ রেকর্ডার, ক্যামেরা, রেডিও ইত্যাদি নিয়ে দেশে ফিরে আত্মীয়দের মধ্যে বিলি করবেন আর বলবেন, তোদের এখানকার রাস্তাগুলো কি নোংরা রে, এখনও জল জমে থাকে, ডোমেস্টিক ফ্লাইটে কি গন্ধ... ইত্যাদি ইত্যাদি...
সুনীলবাবু ফিরেছিলেন পরিভাষা বানানোর টানে না, স্বভাষাকে আরো সাবলীল করার তাগিদে নিজের প্রাণের শক্তিতে। এটাই আত্মবিশ্বাস। হুমায়ুন আহমেদের লেখায় গুচ্ছের পরিভাষা নেই, আছে মৌলিকভাবে বিশ্বটাকে দেখার আত্মবিশ্বাস, ভাষা আপনি জন্মেছে। কালকূটকে, সৈয়দ মুজতবা আলীকে পরিভাষা খুঁজতে হয়নি, নিজের আত্মবিশ্বাসেই পেয়েছেন ভাষার সন্ধান। কারণ ভাষা মস্তিষ্কজাত নয়, ভাষা প্রাণজাত।
উপসংহার
=========
একটাই কথা, আরো আরো লেখা। কেউ না ছাপুক, ফেসবুকে লেখা। নানা বিষয়ে লেখা। যে যে বিষয়ে কাজে আছেন, অকাজে আছেন, যা দেখছেন, অনুভব করছেন, পারছেন, বুঝছেন, সব সব লিখে ফেলা। নিন্দুকেরা বলবে, এত লেখা? কে পড়বে? কেউ পড়বে না। তবু লিখতে হবে। ভাষার জন্য লিখতে হবে। বিসমিল্লা বলে শুরু করুন, কি রামজী বলে শুরু করুন, কি লেনিন-মার্ক্স যাই বলে শুরু করুন। লিখুন। ভাষার জন্যে লিখুন। আরো লিখুন, আরো ভাবুন, আরো দেখুন, আরো শুনুন, আরো পড়ুন। তবে অবশেষে সব কিছুই যেন বাংলায় অনুবাদ হয় আবেগে, যুক্তিতে। ব্যস, দেখতে দেখতে ভাষাটা ছুটবে। শুধু ভাষার জন্য লিখুন। আর কিচ্ছু না। ভালোবেসে যে সত্যই লেখা হয় তাই সাহিত্য। আরো আরো নতুন লেখা তৈরি হোক তাই। সে লেখা রান্নাঘর থেকে গবেষণাগার, ব্রিগেড থেকে নির্জন গঙ্গাতীর --- সবকিছুই ছেয়ে ফেলুক। আমি আশাবাদী।