সৌরভ ভট্টাচার্য
23 January 2020
পার্ক সার্কাসে লাগাতার চলছে ধরনা। "আভি ঘর সে নিকলো ওরনা দেশ সে নিকলোগে"... এই ঘটনাটার বিশেষত্ব হচ্ছে, মহিলারা। দেশজুড়ে নানান জায়গায় মহিলারা সমবেত হচ্ছেন, স্লোগান তুলছেন, রাস্তায় হাঁটছেন, রাস্তায় থাকছেন। আমার স্মৃতিতে এমন ঘটনার সাক্ষী আমি হইনি জ্ঞানত।
অন্যদিকে সদগুরু বলছেন সরকার বোঝাতে পারেনি বলেই আজ দেশজুড়ে এত ক্ষোভ। রাষ্ট্রের পরিচালকের হাবভাব, "যে করে হোক, করেই ছাড়ব"। অর্থাৎ ততটা তারা দেশের নন, যতটা তারা তাদের নিজস্ব ধারণার প্রতি বিশ্বস্ত। ততটা সেই রাস্তায় নামা অজস্র মহিলাদের প্রতি নন, যতটা সাভারকরের ভারতকে রূপ দেওয়ার জন্য। কিন্তু এমন কেন? এ দেশের ছাত্রছাত্রী, রাস্তায় নামা সেই সব ঘর সংসার ছেড়ে আসা মহিলাদেরও তো মন্ত্রী আপনারা। তাদের সাথে সরাসরি কথা বলতে অসুবিধা কোথায়? মঞ্চের কথা তো একপক্ষের কথা, বিতর্ক সভা তো কথার পিঠে কথা, কিন্তু এই মানুষগুলোর পাশে এসে দাঁড়ানোতে, তাদের কথা শুনতে অসুবিধা কোথায়? সদগুরু তার নিজের কম্ফোর্ট জোনের মধ্যে থেকে আইনকানুন না পড়েই অলৌকিকভাবে সমস্তটার ভাব জেনে নিয়ে বারবার বলে চলেছেন, সবটাই বিভ্রান্তির থেকে তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আপনি নিজে এসে দাঁড়াচ্ছেন না কেন? আপনি তো আগে আত্মপ্রচারে জে এন ইউ-তে গিয়েছেন। অনেক সুক্ষ্ম তত্ত্বে আপনার অসাধারণ কথা বলার ক্ষমতায় নিজের মত প্রকাশ করেছেন। আজ তবে এত দূরে কেন? ওদের ভ্রান্তি দূর করার দায় তো আপনারও। আপনি নিজেকে 'এনলাইটেন্ড' ঘোষণা করেন। যার ভারতীয় তর্জমা হল --- দিব্যজ্ঞানসম্পন্ন পুরুষ। আপনার পূর্ববর্তীদের তো এরকম চালচলন ছিল না বাপু? তারা তো অনেক সাধারণ জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে গিয়ে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতিকে সামলেছেন, এমন উদাহরণ জীবনীগুলোতে লেখা হয়। তা আপনার 'ইনার ইঞ্জিনিয়ারিং' কি বাইরের এই প্রতিকূলতায় এমনই অক্ষম যে সে বিরুদ্ধ মতের মুখোমুখি হতে পারছে না?
ভারতীয় যে আদর্শের কথা বারবার বলতে চাওয়া হচ্ছে, সেখানে 'নারী' খুব বড় একটা অধ্যায়। খুব গুরুত্বপূর্ণ, সংবেদনশীল আইনকানুন নারীকে নিয়ে। এখন সেই দেশের এত নারী যেখানে স্বেচ্ছায় নিজেকে এমন একটা অবস্থায় নিয়ে এসে রাতদিন কাটাচ্ছেন সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে, সেখানে প্রাথমিক কর্তব্য এটাই হয় না কি সেই নারীদের সামনে এসে একবার অন্তত দাঁড়ানো? সারা বিশ্বের সামনে মাথাটা হেঁট হয়ে যাচ্ছে যে আমাদের! আপনারা নিশ্চয় অপেক্ষা করছেন তাদের পরাজয়ের, তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার। সে অপেক্ষা কি খুব পৌরুষের? খুব সম্মানকর? জানি না, রাজনীতি কি মানবিকতার চাইতে বড়? রাজনীতি ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য - ইত্যাদি সব কিছুকে ছুঁয়ে সত্তাহীন করে দিতে পারে সে ঘটনা তো উঠতে বসতে দেখছি। কিন্তু মানবিকতাও বিকিয়ে যায় বুঝি?
আসলে এখানে একটা দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাস ও সামাজিক সমস্যা আছে। সেটা জানি। সেটা হল হিন্দু ও মুসলমান ভৌগোলিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে পাশাপাশি থাকলেও, একত্র থাকলেও, এক হয়ে ওঠেনি। তারা কোনোদিন আত্মীয়তায় আসেনি। পঁচিশে ডিসেম্বরে যেভাবে পার্কস্ট্রিট, চার্চগুলো আপন হয়েছে, সেইভাবে ঈদ, মহরমে পার্ক সার্কাস, মসজিদ আপন হয়নি। নানা মহৎ চরিত্রের উল্লেখে যেভাবে বুদ্ধ-খ্রীষ্টের উল্লেখ হয়, সেভাবে মহম্মদের নাম উচ্চারিত হয়নি। বাংলার জাগরণের পর থেকে নানা ধর্মীয় বিপ্লব হয়েছে। সেখানে এক স্বামী বিবেকানন্দ ও অনুকূল ঠাকুর ছাড়া মহম্মদকে নিয়ে বিশেষভাবে আলোচনা অন্য কেউ করেছেন বলে আমি পড়িনি। সে ক্ষেত্রেও অনুকূল ঠাকুরের নানা আলোচনায় যে গভীরতা ও ব্যাপ্তি রয়েছে হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মের নানা দিক নিয়ে সমন্বয়ের আলোচনায় তা বিস্ময়ের, যা অনেক কিছু নতুনভাবে ভাবাতে সাহায্য করে। (এ ক্ষেত্রে আমি "প্রেরিত প্রসঙ্গ" বইটার উল্লেখ করব, বিদ্যুৎরঞ্জন চক্রবর্তী মহাশয়ের দ্বারা সংকলিত, চর্যাশ্রম প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশিত)।
কিন্তু এরকম কয়েকটা বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা ছাড়া এই দুই ধর্মের মানুষ পাশাপাশি হাঁটলেও হৃদয়ের ব্যবধান রয়েই গেছে। দেশভাগের পর মহাত্মা তার বাকি জীবনটার উদ্দেশ্য করেছিলেন এই বিরোধের একটা সমাধানের পথ খুঁজতে (যদিও বহু ভারতবাসী, প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহের মতে যারা ill-informed, তাদের ধারণা মহাত্মাই দেশভাগের জন্য দায়ী। সে পুরোনো তর্কে আমি যেতে চাই না)। মোট কথা, তিনি বুঝেছিলেন যে এই বিষফলই পরে শিকড় গজাবে। চারদিক বিষাক্ত করে তুলবে।
বর্তমান সরকারের প্রথম পাঁচ বছরে এই বিষফল সার পায়নি। কিন্তু পরের অধ্যায়ে এই বিষফলটা হঠাৎ করে সামনে আনা হল। একটা বড় ভুল হল এইখানে। একটা কথা আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হয় তো বুঝতে ভুল করলেন, ভারতবাসী আদতে একটা হিন্দুরাষ্ট্র চায় না। হ্যাঁ, সিংহভাগ হিন্দুরাই চায় না। যদি চাইত তবে RSS -এর শাখা সে প্রতিটা অলিতে-গলিতে তৈরি করত দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এতগুলো বছর ধরে। বারবার সেক্যুলার দলগুলোকে ক্ষমতায় আনত না। এর একটা কারণ আছে প্রধানমন্ত্রী মহাশয় আপনাকে বুঝতে হবে, হিন্দু ধর্ম একটা ব্যক্তিগত জীবনযাপনের ধর্ম, যার মূল বিবেকানন্দের ভাষায় --- আধ্যাত্মিকতা। হ্যাঁ, সেই বিবেকানন্দ, যিনি আপনার জীবনের আরাধ্য, আপনি বারবার বলেন। সেই বিবেকানন্দ হিন্দুধর্মকে অনুভবের ধর্ম বলেছেন, আন্দোলনের ধর্ম নয়। এই ধর্মের মধ্যে নানা দর্শন, নানা মত, নানা বৈচিত্র। আপনি জানেন তো সব, হয় তো আপনার সঙ্গীর বুঝতে ভুল হয়েছিল। বা বুঝতে চাইছেন না। ধর্ম আমাদের ভজনের, ধ্যানের, আলোচনার, শান্তির, ত্যাগের, দিব্যসুখের - তার সাথে এই জড় সংসারের কোনো যোগ নেই, আপনি জানেন। গীতা, উপনিষদ এইগুলোকেই প্রধান শাস্ত্র আপনার আরাধ্য বিবেকানন্দ বলেছেন, যার চূড়ান্ত দর্শন - অদ্বৈতভাব, অর্থাৎ সমস্ত জগতকে 'এক'-এর মধ্যে দেখা। কপিল তার মা-কে ভাগবতপুরাণে শিক্ষা দিচ্ছেন যে 'দুই' বলে সংসারে কিচ্ছুটি নেই। সেই বোধ মিথ্যা বোধ। প্রহ্লাদজী বলছেন, সমস্ত জীবে নারায়ণের প্রতি সশ্রদ্ধ হওয়াই ধর্মের মূল কথা। তবে? তবে আজ এ কোন হিন্দুধর্মের কথা আপনারা বলছেন? যিনি গেরুয়া পরে রাজার আসন থেকে খাবার, কম্বল, তাঁবু কেড়ে নেওয়ার আদেশ দেন, সে গেরুয়া কোন দর্শনের? ব্যাঙ্গালোরে যেখানে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে এতগুলো মানুষের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হল, সে কোন রাজধর্ম রাজা? আমি স্তম্ভিত, আমি লজ্জিত।
ভারত তার জয়যাত্রা এগিয়েছিল প্রাচীনকে ধর্ম করে নয়, আগামীকে লক্ষ্য করে বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজনীতিকে মানবনীতির উপর দাঁড় করাতে চেয়ে। তার প্রজাকে ভয়মুক্ত, উদার জীবনের দিকে নিয়ে যেতে। ঈশ্বর তো অমর, তাঁর নীতি প্রাচীন শাস্ত্র ঘেঁটে বার করতে হবে এমন তো উপনিষদ বলেনি রাজা? বরং উপনিষদ বলেন সমস্ত শাস্ত্র মিথ্যা যদি হৃদয় না জাগে, অন্যা বাচ বিমুঞ্চথ, অন্য বাক্য ত্যাগ করো, হৃদয়ে সেই এক যিনি তাকে অন্বেষণ করো, যিনি সমস্ত জগতের মধ্যেও এক। ভেদ কোথায় রাজা?
হ্যাঁ, তবু ভেদ আছে, মানু্ষের অজ্ঞতায়। সেই অজ্ঞতাকে কি পুঁজি করবে রাজা? টিকবে না। এ মাটি ভারতের মাটি। ভারত না তো ভৌগলিক প্রকৃতিতে একঘেয়ে, না তো আত্মিক স্বভাবে একদেশি রাজা। তুমি ব্যর্থ হবে। একটা গান দিয়ে শেষ করি---
রইল বলে রাখলে কারে, হুকুম তোমার ফলবে কবে?
তোমার টানাটানি টিঁকবে না ভাই, রবার যেটা সেটাই রবে॥
যা-খুশি তাই করতে পারো গায়ের জোরে রাখো মারো---
যাঁর গায়ে সব ব্যথা বাজে তিনি যা সন সেটাই সবে।।
অনেক তোমার টাকাকড়ি, অনেক দড়া অনেক দড়ি,
অনেক অশ্ব অনেক করী--- অনেক তোমার আছে ভবে।
ভাবছ হবে তুমিই যা চাও, জগৎটাকে তুমিই নাচাও---
দেখবে হঠাৎ নয়ন খুলে হয় না যেটা সেটাও হবে।।