মানুষ বাণীতে বাঁচে। অতীতে বাঁচে। আক্ষেপে বাঁচে। ক্ষোভে বাঁচে। ঈর্ষায় বাঁচে। প্রতিযোগিতায় বাঁচে। ছলনায় বাঁচে। ক্রোধে বাঁচে। বিষণ্ণতায় বাঁচে। অপমানে বাঁচে। অহঙ্কারে বাঁচে। হীনমন্যতায় বাঁচে। রোগে বাঁচে। অভাবে বাঁচে। প্রাচুর্যে বাঁচে। মধ্যবিত্ততায় বাঁচে। অলসতায় বাঁচে। উদ্যমে বাঁচে। ভয়ে বাঁচে। সাহসে বাঁচে। দুশ্চিন্তায় বাঁচে। উদাসীনতায় বাঁচে। আনন্দে বাঁচে। যৌনতায় বাঁচে। ঈশ্বরকে জড়িয়ে বাঁচে। ঈশ্বরকে হারিয়ে বাঁচে। হাসতে হাসতে বাঁচে। কাঁদতে কাঁদতে বাঁচে। আশায় বাঁচে। আকাঙ্ক্ষায় বাঁচে। কথায় বাঁচে। জেগে বাঁচে। ঘুমিয়ে বাঁচে।
ক্ষণে বাঁচে? মানে বিস্মৃতিতে বাঁচা, স্মৃতিতে বাঁচা - সে কথা না। এই ক্ষণে বাঁচে? এই মূহুর্তে বাঁচে? কোনো ধ্যান না। কোনো আশা না। কোনো ভয় না। অতীত না। ভবিষ্যত না। রাগ না, অভিমান না, আনন্দ না, উচ্ছ্বাস না। প্রদীপের শিখার মত এই ক্ষণটিতে মনের মধ্য থেকে যে আলো আসছে, সে যতটুকু আলোই হোক না, সেই আলোতে শুধু এইক্ষণটুকুতে বাঁচে? অতীতের জানলা আর ভবিষ্যতের দরজাটা খানিক ভুলে এই সময়টুকুতে উপচে পড়ে বাঁচে? বাঁচা যায় কি?
মন তা হতে দেয় না। হয় অতীতে না হয় ভবিষ্যতের কল্পনায় ঠেলে নিয়ে যায়। তার একটা কারণ কি মন নিজের অস্তিত্ব সংকটে ভোগে? অতীত আর ভবিষ্যতের ধারক, রক্ষক, জন্মদাত্রী তো সে নিজেই, তাই এই দুইকে উপেক্ষা করলে কি সে মুষড়ে পড়ে? বলে, আমি তবে কি করব? আমি তবে কোথায় যাই? এসো তোমায় স্মৃতির সেঁক দিই, নইলে ভবিষ্যতের সুখস্বপ্ন পালকে সুড়সুড়ি দিই। আর মেজাজ যদি বিগড়ে থাকে তবে অতীতের কয়েকটা কাঁটা তুলে দিই, নইলে ভবিষ্যতের কিছু স্বার্থসিদ্ধির পরিকল্পনা ছকে দিই - কি বলো? রাজি? মনের বাতাসে চিত্তশিখা টলমল। তবে ক্ষণে বাঁচা কি যায় না?
যায়। কিন্তু আমি যে তুলনা প্রিয়। আমার মধ্যে কি সব সময় তুলনাখেলা চলে না? আমার বন্ধুর পোশাক থেকে ফেসবুক লাইক সংখ্যা, ট্রাম্পের গাড়ি থেকে হাঁদুদাদুর অ্যাম্বাসাডার - সবই কি আমার তুলনার বস্তু না? সব তুলনাতেই মানুষ অসুখী। তবু তুলনা করতেই হয়, কারণ তুলনার মধ্য একটা লটারির আনন্দ। অ্যাড্রেনালিন সুখ। তোমার পাওয়া, না পাওয়ার সাথে আমার পাওয়া না পাওয়ার। এই তুলনা দুই ধরণের হতে পারে, কি ধরণের হবে তা নির্ভর করে মানুষটার ধাত কেমন।
যদি একটু দুঃখ বিলাসী হয়, তবে সে নিজের না পাওয়ার তালিকা বানিয়ে ফুটপাথ থেকে রাজগৃহ সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে কার সাথে কোথায় সে কতটা পিছিয়ে। যত সে পিছানোর দূরত্ব বাড়বে তত সে দুঃখ, হতাশায় ডুববে আর তত একটা মোহগ্রস্থ হওয়া আনন্দ তাকে চেপে ধরবে। কেন? কারণ মানুষের গভীরে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার একটা আদিম তাগিদ। কিছু একটা তো চাই, তাই আর কিছু না পেলে নিজের অপূর্ণতার লিস্টি বানিয়ে নেকু কান্না কেঁদে, ফেসবুক থেকে বন্ধুদের কানের পোকা অবধি সানাই বাজিয়েই চলবে, বাজিয়েই চলবে।
যদি অহং বিলাসী হয়, তবে সে নিজের পাওয়াগুলোকে অতি পাওয়া করে নিজের মধ্যে আত্মশ্লাঘা অনুভব করবে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ভয়ও পাবে, কোনদিন যায় খসে। আবার পাশাপাশি ঈর্ষা আর অভিমানের গুঁতোও চলবে। তুল্যমূল্য বিচারের দাঁড়া কোনদিকে কতটা ঘোরে তার উপর সে মনের গতি নির্ভর করছে। মন বুঝে কথা না বললে, সায় না দিয়ে চললে শ্রোতার কপালে অশেষ দুঃখ। সে যা বলবে তার উল্টো মানে বুঝে নিতে হবে। শ্লাঘা সোজাসুজি কথা বলতে চায় না। যদি বলে লাল, তবে বুঝো নীল।
তবে কি মানুষ ক্ষণে বাঁচা অভ্যেস করতে পারে? না, পারে না। এ মেলা শক্ত ব্যাপার। তুলনাহীন মন যদি হতে পারে সে ক্ষণে বাঁচে। তুলনাহীন মন সুরের পিয়াসী। তার কথার চাইতে সুর আসে বেশি। সুরের কোনো তুলনা নেই। সুরের কোনো বক্তব্য নেই। সুরের কোনো অবয়ব নেই। সুরের কোনো চাহিদা নেই। তাই যে সুরের তৃষ্ণায় মজেছে, তারই তুলনার পেণ্ডুলাম থেমেছে, সেই ক্ষণে বেঁচেছে, সুরে বেঁচেছে। যতটা বাঁচা যায় ততটায় মঙ্গল। "সুরহারা প্রাণ বিষম বাধা, সেই তো আঁধি, সেই তো ধাঁধা/ গান-ভোলা তুই গান ফিরে নে, যাক সে আপদ ছুটে।"
সৌরভ ভট্টাচার্য
12 November 2018