Skip to main content


মানুষ কবে সভ্যতার প্রথম সোপানে পা রাখল ইতিহাসবিদরা বলতে পারেন। কিন্তু প্রথম কবে একে অন্যকে বোকা বানাতে শুরু করল কেউ বলতে পারেন? কেউ জানেন না। ইতিহাসবিদদের কথা না হয় থাক। আমাদের মহাভারতে দেখুন, এক কুরুক্ষেত্র হয়ে গেল কি না সেই একবার দ্রৌপদী হেসেছিল বলে। মনে নেই? কেউ কেউ বলেন না? সেই যে গো, পাণ্ডবদের গৃহপ্রবেশের দিন। সে নাকি যেখানে মনে করো দরজা সেখানে স্ফটিক নির্মিত দেওয়াল। ফলে দুর্যোধন কি নাস্তানাবুদ হয়েছিল। তা যেই না দুর্যোধন মুখ থুবড়ে ধাক্কা খেয়ে পড়েছে, অমনি দ্রৌপদী আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না, 'হো হো' করে হেসে উঠল, বলে 'কানার ছেলে কানা'। না, অতবড় ঠাট্টাটা আর নেওয়া গেল না, ব্যস... লেগে গেল কাঁটা দুর্যোধনের বুকে। তারপর তো সে পাশাখেলা, বস্ত্রহরণ মায় কুরুক্ষেত্র অবধি গড়িয়ে তবে শেষ হল। উফ্‌, বোকা বানাবার কি মূল্যই না চোকাতে হল গা। পুরো বংশটা প্রায় নির্বংশ হওয়ার জোগাড়! 
        একটা গল্প মনে পড়ল। ওই বোকা বানানো নিয়েই আর কি। এক গ্রামে এক বড়লোক মোলো। তার দুই ছেলে। ধামড়া ছেলে কিন্তু কিছু করে নাকো। বাপের পয়সায় বসে বসে খায়। এদিকে শখ ষোলো আনা, বিয়েটিয়ে সব সারা। সে বড় গরীব গ্রাম ছিল। কেউ মারাটারা গেলে মন্দিরে পূজো দিয়ে দিত দশদিন পর, ব্যস ওইতেই তাদের স্বর্গবাস হয়ে যেত। তা গরীবদের স্বর্গ আর কি। কিন্তু এরা তো বড়লোক, এরা কেন ওরকম করে শ্রাদ্ধ সারবে? তারা সারা গ্রাম নেমন্তন্ন করল। গয়া থেকে পুরুত ডাকা হল। আর ধনী মানে ওদের কাজের লোককে বলা হল সারাটা উঠোন গোবর দিয়ে নিকিয়ে দিতে। 
        সব ব্যবস্থা হল। শ্রাদ্ধ শুরু হল। গ্রামের লোক গিজগিজ করছে। শ্রাদ্ধ কাকে বলে দেখবে। এর মধ্যে হল কি, শ্রাদ্ধ চলতে চলতেই দুই ভায়ের মধ্যে বচসা বেধে গেল, বাপের সম্পত্তি নিয়ে। প্রথমটায় মুখে মুখে, তারপর হাতাহাতি। এ ওর গলা টিপে ধরে, ও এর গলা টিপে ধরে। লোকজনের মধ্যে বেশ একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল, তারা ভাবলে এই বুঝি শ্রাদ্ধের একটা রীতি। ওদিকে দুইভাই মারামারি করতে করতে গড়াগড়ি দিতে দিতে এক্কেবারে নিকানো উঠান ছাড়িয়ে গ্রামের রাস্তায়। লোকজন তাদের পিছুপিছু, বড়লোকদের শ্রাদ্ধ বলে কথা। কিন্ত ওদিকে সে ধনী কাজের মাসি ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠেছে, সে বুক চাপড়াচ্ছে আর বলছে, "হায় হায় রে, শ্রাদ্ধ এতদূর গড়াবে আগে জানলে আমি পুরো গ্রাম গোবর দিয়ে নিকিয়ে দিতুম গো!”

        তা এই হল গল্প। আসলে আমাদের বোকা হওয়াটা ভাগ্যের গোড়া থেকেই লেখা আছে। আর কেউ আমায় বোকা বানাক না বানাক নিজেকে বোকা বানাবার কোনো সুযোগ কি ছাড়ি? বার্ট্রাণ্ড রাসেল এক জায়গায় বলেছিলেন, 'বদ্ধোন্মাদ হওয়ার পূর্বলক্ষণ হচ্ছে, নিজেকে আর নিজের কাজকে জগতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা।' আহা, কি খাঁটি কথাখানা! নিজেকে বোকা বানাবার বিস্তর কায়দা আমরা জানি। প্রথমটাই হল, নিজেকে অত্যন্ত চালাক মনে করা। উফ্‌ এ যে কি রোগ! যে যাই বলে সন্দেহ। "উঁহু তা কি করে হয়! আমার তো এরকম মনে হয় না"... ইত্যাদি। এমনকি বোকা বনে গেলেও স্বীকার করব না, এমন গুমোর। এ আরেক ঝঞ্ঝাট। ফলে আরো বোকা হওয়ার রাস্তা খোলা। এ ছাড়া বিস্তর ভুল বিশ্বাস তো আছেই। সেই রামপ্রসাদের গান, “ওমা নিম খাওয়ালে চিনি বলে"... অর্থাৎ কি না বোকা বানাতে দেব-দেবীরাও ছাড়ে না। তবে যাই কোথা? আহা, ওই যাওয়ার লগে বাসনাটাও তো আরেক বোকামি। যেতেই বা হবে কেন? বোকা হওয়ার তো একটা সীমা আছে, না কি? সেটা না দেখে, যাবোই বা কেন? 
        ভালোবেসে বোকা বনে পাগল হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা কিছু কম নয়। একে ভালোবাসা অন্ধ, তায় বোকা বনিয়ে নিলে সুদটুকু তো পাওয়া যায়ই আসলটাও গাপ করা যায়। সে সুযোগ আর ছাড়া কেন? এ সব আদিম গল্প। আসল কথাটা হচ্ছে অন্যের হাতে বোকা হওয়া নয়, নিজের হাতে বোকা হওয়া। অলসতা আর লোভ - এই দুইখান যত নষ্টের গোড়া। লটারির টিকিট কাটা কোন গোত্রের ধম্ম জানি না, তবে অনেককে দেখেছি সারাটা জীবন লটারির দর্শনে বিশ্বাস করেন। এদের অদৃষ্টবাদী বলে বোধহয়। এদের দেবতা থেকে মানুষ কেউই বাদ দেয় না বোকা বানাতে। এ তো গেলো ব্যবহারিক জীবনের বোকা হওয়ার গল্প। আর জ্ঞানের জগতে?
        মজার কথা হচ্ছে, এইখানে আবার উল্টা নিয়ম। সেই 'stay hungry, stay foolish' -এর গল্প এখানে। এখানেও যেই তুমি নিজেকে চালাক ঠাওরেছ অমনি মুখ থুবড়ে মাটিতে। এই জগতের শ্রেষ্ঠ পুরুষ তাই সক্রেটিস মহাশয়। তিনি বারবার বলতেন, 'আমি সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী হিসাবে নিজেকে দাবি করতে পারি, কারণ আমিই একমাত্র জানি যে আমি কিছু জানি না।' কি চমৎকার কথা! অর্থাৎ বোকা থাকো, জেগে থাকো। নিজের বোকামিকে যদি চিনতে পারা যায় সেই তো সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান। তবেই তো জ্যোতিষী থেকে আমাদের তৈরি দেবতারা আমাদের সমঝিয়ে চলবে। কারণ তারা তো জেনে গেছে যে আমি আমার বোকামির সীমারেখা জেনে গেছি।
        আর ভগবান? আমার সব বোকামিকে যিনি আমার অন্তরে বসে, মাষ্টারের মত লালদাগ দিয়ে চিহ্নিত করে যাচ্ছেন, তাকেই মানি। আমাদের বানানো মন্দির মসজিদ চার্চের ছাদের তলায় থাকা দেবতাদের বুঝি না। কারণ তাদের যে হারে বোকা বানাই আমরা! মা গো মা! একটা বিশ্বের কতগুলো বিশ্বস্রষ্টা হয় কে জানে বাপু! তার মধ্যে কেউ শুনি গরু খেলে গোঁসা করে আবার কেউ শুয়োর খেলে। এতবড় ব্রহ্মাণ্ডে কে কি খাচ্ছে এই খবর নিয়ে যদি ঘর চালাতে হয় সে ভদ্রলোককে তবেই হয়েছে! কি বোকাই বানিয়েছি ব্যাটাকে! তাই তারে ছেড়ে ওই বুকের মধ্যে নড়াচড়া করে যে, তারেই চিনতে চাচ্ছি, যাকে হাজার চেষ্টাতেও বোকা বানানো যায় না গো!
        সংসারে চালকের আসনে তাই রেখেছি হৃদয়কেই। বুদ্ধিকে ঘরদোর মোছার কাজ দিয়েছি, ওকে আলমারির চাবি দিলে মাথা খারাপ করে দেবে। ঠকে যাব? হে হে, সে ভয় বুদ্ধিরই কেবল, হৃদয়ের নেই। সে বোকা হওয়া আর বোকা করার ঊর্দ্ধে বলেই এমন বোকা সেজে থাকে। ওইতেই বুদ্ধির এত ভয় ওকে নিয়ে। তাই সে চোখাচোখি হতে পিছিয়ে যায়। হৃদয় চোখে না তাকিয়েও চোখের মণিতেই তাকায়। তবে আর ভয় কি?