Skip to main content

আত্মপ্রচারসর্বস্ব "আমাকে দেখুন" বইমেলা শেষ হল, "ভ্যানিটিব্যাগ" সদৃশ বহু বই বিকিকিনি শেষ হল, বহু "নর্দমায় আছাড়ামারার যোগ্য" হুজুগে পাঠকের বার খেয়ে তোলা লেখকরাও বাড়ি ঢুকে গেল।

মেলায় রোদ বাড়ছে। শীত যাচ্ছে। ফেসবুকে প্রতিবাদ হচ্ছে। এক বিশাল অংশের নেটিজেন নিন্দুক-প্রতিবাদী, এই দুই পক্ষের পোস্টেই "দারুণ বলেছেন" বলে লাভ / কেয়ার ইত্যাদি ইমোজি দিয়ে আসছেন।

এখন এমন তো শিশু নই যে বেশ কিছু মানুষের ব্যবহারে সততা, ইন্টিগ্রিটি, দায়বদ্ধতা ইত্যাদি দেখছি না বলে হাহুতাশ করে মরব।

আপনারা মানুন, না মানুন, আমার আম্বেদকরের একটা কথা খুব মনে হয়। ভারতে আমাদের রক্তে শ্রেণী সচেতনাটা মারাত্মক। আমাদের বেদ-বেদান্তে যাই লেখা থাকুক না কেন, আমাদের মনীষীরা যাই বলে থাকুন কেন, আমাদের বর্ণাশ্রম-জাত-কাস্ট এর ফ্রেমওয়ার্কের ধারণাটা মজ্জাগত। আম্বেদকর যাকে বলতেন, "স্টিলের ফ্রেম"। আমরা এক একটা গোষ্ঠী বানিয়ে, তার একটা হায়ারার্কি মনে মনে ছকে নিই। এগুলো কোনোটাই সচেতনভাবে আমরা করি না। কিন্তু করি। এগুলোতে যে কোথাও মনুষ্যত্বের প্রাথমিক শর্তগুলোকে অবমাননা করছি, সেও আমাদের মনে হয় না। রেলকলোনিতে বড় হয়েছি। সেখানে আউটহাউস বলে, কোয়াটার্সের বাইরে, একটা করে ঘর-বারান্দায় বাস করা কাজের লোকেদের জন্য বাড়ি থাকত। এখনও আছে। অফিশিয়ালি থাকার কথা না। তবু আছে। আমি দেখতাম তাদের কেউ যদি কোনো দামী শাড়ি পরে কোনো অনুষ্ঠানে যেত, অমনি কোয়াটার্সের "মালকিন" রা সেই জাতের শাড়ি আর পরতেন না। নাক কুঁচকিয়ে বলতেন, ইস, ও ওই ধরণের শাড়ি পরেছে। আমিও পরব? ওরা ওই রেস্টুরেন্টে যায়, আমরাও যাব? কেন আমাদের একটা জাত নেই?

আমাদের ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যে এই “জাত” শব্দটা ভীষণ ধ্রুব। একটা স্বত:সিদ্ধান্ত। আম্বেদকর এই সত্যিটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই আজীবন হিন্দুধর্মের, তথা সমাজে এই বিষযন্ত্রটাকে থামাতে চেয়েছিলেন। না পেরে অবশেষে বৌদ্ধধর্ম নিয়েছিলেন। সঙ্গে হাজার হাজার মানুষকেও নিয়ে গিয়েছিলেন।

আমাদের রক্তে রক্তে এই “আনটাচেবেলিটির” বীজ আছে। কেন, রমাপদ চৌধুরীর “বাড়ি বদলে যায়” মনে নেই? শেষে যখন নিজেদের বাড়ি হল, তারা নিজেরা বাড়িওয়ালা হল, মানুষটা বলল, ভাড়াটাদের জাতটাই এরকম হয়।

একবার ভেবে দেখবেন আমাদের ভাবনা, চিন্তা সব কিছু কি সাংঘাতিকভাবে এই “জাত” শব্দটা দিয়ে প্রভাবিত। এটা যে অন্যায়, এ বোধটাও আমাদের আসে না। এই হাজার হাজার বছরের অভ্যাসে এতটাই এই বিষয়ে অসংবেদনশীল হয়ে আছি আমরা।

বইমেলাতেও তাই বইমেলার মত করে “আনটাচেবিলিটি” শব্দটা আছে। নইলে একজন অমন ক্ষমতাসম্পন্ন লেখিকার মনে এত বিদ্বেষ, এত ঘৃণা, এত তাচ্ছিল্য জন্মায় কেন? কারণ আমাদের “আনটাচেবেলিটি” ধারণার মধ্যে একটা বিবেকীয় লেজিটিমিটি আছে। আমরা জানি আমাদের এই বোধটা ধর্মসম্মত। ওর “ওউকাত” এর বাইরে ও যাবে কেন?

বর্ণাশ্রমের বিষটা বহু হাজার বছর আগে খুব নিষ্পাপ মুখোশে, সংজ্ঞায় আমাদের সমাজে জন্মেছিল। তারপর বর্ণ মানে জাত নয় - ইত্যাদি সুক্ষ্ম তর্কে আরো কায়েমি হল। তারপর সে বিষ শুধু ধর্ম না, পুজো-আচ্চা না, আমাদের সব বিচার, আচারে, সামাজিকতায় ঢুকে পড়ল। আমাদের মধ্যে এক নতুন ধরণের “আদারিজম” চালু হল। এক নতুন ধরণের “আনটাচেবিলিটি”।

বইমেলা নিয়ে পোস্টে আমার কিছুই মনে হয়নি। বিখ্যাত লেখিকা প্রমুখদের পোস্টেও আমার কিছুই মনে হয়নি। কিন্তু যখন আমার বন্ধুতুল্য বেশ কিছু মানুষকে দেখলাম ব্যথা পেয়েছেন, প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন, আমার মনে হল আমিও আমার ভাবনাটা রাখি। বলি যে, রোগের বীজ অনেক গভীরে। আমাদের এখানে গ্রহণের চাইতে বর্জনের দামামা বেশি জোরে বাজে। আমাদের এখানে হাত বাড়ানোর চাইতে, হাত গুটিয়ে নেওয়া ঘেন্নায় অনেকে সহজে করা যায়। আমাদের যুগান্তরের অভ্যাস এ। আমাদের ধর্ম শিখিয়েছে।

শুধু আম্বেদকর নয়, হরিচাঁদ ঠাকুর-গুরুচাঁদ ঠাকুরও এ বিষের খবর পেয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের সমাজে তাদের কথা কোনোদিন গ্রাহ্য হবে বলে আমার অন্তত মনে হয় না। কিন্তু এনারা তো ইতিহাস এখন। কিন্তু “জাত” নিয়ে আমাদের নিজেদের মত করে “আমরা - ওরা” গড়ে তোলার খেলা চলতেই থাকবে। পৃথিবীর সব দেশেই এটা আছে কমবেশি। কিন্তু ভারতেই একমাত্র এই অমানবিক আচার শাস্ত্রের সমর্থন পেয়েছে। যুগ যুগ ধরে আমাদের কাউকে মহান, কাউকে তুচ্ছ করার অদ্ভুত সমীকরণ শিখিয়েছে। আজও চলছে। অন্যভাবে। তার একটা উদাহরণ এই বইমেলা ঘিরে পোস্টগুলো। এগুলো চলবেই। হতাশ হবেন না। বরং যতটা পারা যায় আমাদের মধ্যে থাকা এই কুলীনতার বিষাক্ত বীজটাকে মারা যায়, সে চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।