Skip to main content
বাঙালী জাত প্রতিবাদের ক্ষমতা হারিয়েছে। তাই কি? খিস্তি-হুমকি, ভজন-ভাষণ, নীলছবি-আঁতেল ছবি, খুন-ধর্ষণ সব হজম হয়ে যাচ্ছে নির্বিকার। কি এমন হজম শক্তি আয়ত্ত করেছে বাঙালী? না, কোনো রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর কথা বলছি না। বলছি সামাজিক মানসিকতার দিক থেকে। প্রতিটা মানুষের যেমন একটা মনের গতি থাকে আর তা যেমন সময়ের সাথে সাথে বদলায়, তেমনি সমাজেরও এক-একটা সময়ে গতির মুখ বদলায়। তারই কিছু ভাবনা চিন্তা। কয়েকটা ভাগে ভাগ করে নেওয়া যাক।
 
 
     প্রথমত: মেকি আদর্শবাদীতা। বাঙালী মানেই তাকে প্রচ্ছন্ন বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ, রবি ঠাকুর, নেতাজী হতেই হবে, এ যেন অলিখিত শর্ত। স্বামীজির একটা উক্তি এই প্রসঙ্গে আমার বার বার মনে আসে। উনি বলতেন শুধু আদর্শহীনতাই কোনো জাতকে নষ্ট করে না, উচ্চ আদর্শও করে। হ্যাঁ করে। আমি এমন এক আদর্শে জীবন যাপন করতে চাইলাম যা বাস্তবে আমার দ্বারা কখনই হওয়ার না, তা আমাকে ভিতরে ভিতরে দুর্বল করতে থাকে। আমাকে মনের গভীরে বিষাদগ্রস্ত করে তুলতে থাকে।
    জীবনে যে কাজ, যে সাধ খুব স্বাভাবিক তাকে আমরা সমাজে অপাঙতেও করে রাখলাম আদর্শের অজুহাতে। "ওটা বাঙালীদের সাজে না" - এর চূড়ান্ত পরিণতি, একটা ভণ্ড, দুর্বল, ঈর্ষাপরায়ণ সমাজ।
 
 
     দ্বিতীয়ত: পরিবর্তনের প্রতি অনীহা। আমি আগেই বলেছি আমি কোনো রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ আলোচনা করছি না। আমরা কিছুকে একবার চূড়ান্ত স্বীকৃতি দিতে পারলে সেখান থেকে আমাদের সরায় কার বাপের সাধ্যি। রবি ঠাকুর, সত্যজিৎ, উত্তম-সুচিত্রা - সব আমাদের অন্তিম পরাকাষ্ঠা। এঁরা মহৎ এতে সন্দেহ পাগলেও করবে না। কিন্তু যেই ইতি টানলাম অমনি আমার চলাটাও যে থেমে গেল? এই ক্ষতি পূরাবে কে?
     "এর উপরে আর হয় না"- বসে গেল স্ট্যাম্প। হয়ে গেলাম ইতিহাস। গঙ্গা দিয়ে যত জল বয়ে যাক, বাগানে যত নতুন ফুল আসুক, আমার তাতে কি? আমি তো ইতিমধ্যে জেনেই গেছি এর চেয়ে ভাল হয় না। থাকো নাক কুঁচকে, ব্যাস।
 
 
     তৃতীয়ত: পার্থিব উন্নতির প্রতি কপট উদাসীনতা। যে যত গরীব সে তত সৎ। এ এক কঠিন ব্যামো। মনের কত গভীরে ঢুকে আছে এ শিকড় তা ভগবানই জানেন। আমরা আওড়াই, টাকা মাটি, মাটি টাকা। সৎ প্রমাণ করার জন্য নিজের স্বাভাবিক ইচ্ছার দমন অনিবার্য। ফল, ভিতরে-বাইরে দুদিকেই কাঙালপনা। অন্য রাজ্যের লোক ব্যবসা করুক, বড়লোক হোক তোমার তাতে কি। তুমি হলে গিয়ে পরমহংস দেবের বংশধর। তুমি ওসব কোরো না। তাতে ইহকাল পরকাল সব ঝরঝরে।
     ব্যস হয়ে গেল সিদ্ধান্ত। বড় হাসপাতাল, সিনেমার প্রযোজক, বড় ব্যবসা এসবে বাঙালী খোঁজ, আতস কাঁচ লাগবে। আমরা কেন ওসব করব! কোথাও যেও না। ওগুলো ওরা করুক। আমরা ওসব করলে, কে ওদের সমালোচনা করবে। বালাইষাট! ওসব লোভের পথে যেও না।
 
 
     এই রকম অনেক অবাস্তব আদর্শ জগতে বাস করতে করতে বাঙালী বুঝলই না আশেপাশের রাজ্য কবে জেগে উঠেছে। কি প্রকান্ড কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। যখন জানল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন সে জানে তার স্বাস্থ্য, শিক্ষা সব কিছুর উৎকৃষ্টতার জন্য তাকে আজ দক্ষিণের, উত্তরের, পশ্চিমের দ্বারস্থ হতে হয়। সে মেনে নিয়েছে।
কখন মেনে নেওয়া যায়, যখন আত্মসম্মানের দীনতা আত্মম্ভরিতার জাল ছিঁড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ে।
     সেই জাত কিসের জোরে একজোট হবে? কিসের জোরে প্রতিবাদী হবে? তাই বিচ্ছিন্ন কয়েকটা প্রতিবাদ ছাড়া আমরা বহুলাংশে নির্জীব আজ। আজ আশা নতুন প্রজন্মের কাছে। তারা এই আদর্শ বিলাসিতা থেকে আমাদের জাগিয়ে যদি আবার নতুন করে শুরু করাতে পারে। আমরা বেঁচে যাই।