তবে কি আমি প্রতিষ্ঠান বিরোধী? কিন্তু তা তো মোটেও নয়। জন্মালাম একটা হাসপাতালে, পড়াশোনা করলাম স্কুল-কলেজে, টাকা রাখতে ব্যাঙ্কে গেলাম, চিঠি পোস্ট করতে পোস্ট-অফিসে... এ সবই তো প্রতিষ্ঠান। সমাজের পক্ষে অপরিহার্য। এছাড়াও বিধানসভা লোকসভা থেকে শুরু করে আরো নানান প্রতিষ্ঠানের সাথে জীবনযাত্রা তো প্রতিপদে জড়িয়ে। তবে? ক'দিন ধরে একটাই কথা মাথায় ঘুরছে, তবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অর্থ কি, প্রয়োজন কি?
ধর্মের সংজ্ঞা নানান। তার একটা নীতির দিক আছে আরেকটা বিশ্বাসের দিক আছে। আর এই দুই মিলিয়ে একটা 'আদর্শ' তৈরি করে তাতে বাঁচার দিক আছে। তাই বলা হয় কোনো আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখতে একটা প্রতিষ্ঠান তথা সঙ্ঘের দরকার আছে - সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি। কিন্তু বাঁচিয়ে রাখা মানে কি? কোনো কিছুর পুনরাবৃত্তি করে যাওয়া? কোনো অনুষ্ঠানের, কোনো তত্ত্বের কথা বারবার আওড়িয়ে যাওয়া? প্রতিটা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের একজন প্রতিষ্ঠাতা বা কেন্দ্রপুরুষ থাকেন। তিনি তার সময়ে কোনো এক বিশেষভাবে সত্যকে উপলব্ধি করেছিলেন, তারপর সেই 'বিশেষ ভাবটি'কে প্রথা করে পরবর্তী অনুগামীগণ তার পুনরাবৃত্তি করে যেতে থাকে। সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা হয়। পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসাবে সাম্প্রদায়িকতা। ক্রমশঃ প্রাণহীন শুষ্ক আবর্তনে জীবনযাত্রা অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। একটা জড়ত্বের শান্তি মনকে আচ্ছন্ন করে রাখতে চায়। সেই বিরোধী কোনো কথা হলেই মনের ভিতর তীব্র প্রতিবাদ ওঠে। বিরোধীপক্ষ যদি দুর্বল হয় - 'রণং দেহি' দল পাকিয়ে, আর যদি সবল বিরোধীপক্ষ হয় তবে পালিয়ে গিয়ে নিন্দা, তাও সদলবলে।
তো যে কথাটা বলছিলাম, তবে কি পুনরাবৃত্তিই আদর্শকে ধরে রাখার একমাত্র কৌশল? পুনরাবৃত্তিতে কি সত্যলাভ হয়? পুনরাবৃত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে কি আশা করা যায় যে সব যুগে সে তার প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখতে পারবে? পারবে না। আর তাই বিরোধ অবশ্যম্ভাবী। সময় একটা গতি, আর পরিবর্তন একটা অপরিবর্তনীয় নিয়ম। তার চাইতেও বড় কথা মানুষ তার জীবনের গভীরতম সত্যের খোঁজ কি সম্প্রদায়ের মধ্যে পায়? নাকি কোনো সম্প্রদায়কেই সেই সত্য বলে নিজেকে আশ্বস্ত করার আত্মপ্রবঞ্চনামূলক প্রয়াস পায়? বলা হয়, every religion starts with a blasphemy... প্রতিটা নতুন ধর্মই পুরোনো ধর্মের সমালোচনা দিয়ে শুরু হয়। আসলে পুরোনো ধর্মের না, ওই প্রাণহীন শুষ্ক পুনরাবৃত্তির ভূতকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্য সে হাঁক দেয়। ওঠে ঝড়। রক্ষণশীলের দল চিরটাকাল থাকে, তারা তুমুল চীৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। দেখে মনে হয় আদর্শের প্রতি চূড়ান্ত আনুগত্য থেকে তারা বুঝি এমন অধীর হয়ে উঠেছে, কিন্তু আদতে তা না। তারা ওই পুনরাবৃত্তির ধারার সাথে নিজেদের অস্তিত্বকে এমন আঁকড়ে ফেলেছে যে সেই ধারার মৃত্যুতে তারা নিজেদের অস্তিত্ব সংকট অনুভব করছে। সেদিন শুনলাম কোনো এক নব্বই পেরোনো সন্ন্যাসী অসুস্থ শরীরে, রোগের আচ্ছন্ন ঘোরের মধ্যেও তার জপের মালাটা হাতড়িয়ে খুঁজে জপে বসার চেষ্টা করছিলেন। তার শিষ্যরা অত্যন্ত গর্বের সাথে সে উপাখ্যান বর্ণনা করছিলেন, ভক্তিতে গদগদ হয়ে। কথাটা শুনেই আমার মনটা এমন বিকল হয়ে গেল, এই নাকি সিদ্ধাবস্থা? একটা অভ্যাসের কাছে নিজের সমস্ত প্রাণশক্তির জলাঞ্জলি দিয়ে তাকে একটা স্থবির পুনরাবৃত্তির যন্ত্র বানিয়ে ফেলাটাই জীবনের চূড়ান্ত প্রাপ্তি? কিন্তু তাই তো হবে। কারণ আবর্তনের ধারা বজায় রাখাই যে প্রতিষ্ঠানের মূল, সে প্রতিষ্ঠানে ইনি তো সর্বোচ্চ স্থানের অধিকারী হবেনই।
মাঝে কলেজ জীবনে বেশ কিছু ধর্ম ও বিজ্ঞানের একতাদর্শী কিছু বই পড়েছিলাম এক বিখ্যাত সন্ন্যাসী প্রবরের। মুগ্ধ হয়েছিলাম। আজ আর সে মুগ্ধতা নেই। কারণ আজ তার অন্তঃসারশূন্যতাটা চোখের সামনে স্পষ্ট। আমি যখনই ধর্মের যথার্থতা প্রমাণের জন্য অমুক বিজ্ঞানী তার অমুক লেখায় অমুক কথাটি বলেছেন বলতে শুরু করব, তখনই বুঝতে হবে যে আমার ধর্মবিশ্বাসের অন্তরালে কোথাও বেনোজল ঢুকছে। তখন আপাতদৃষ্টিতে অকাট্য সব যুক্তির সামনে শ্রদ্ধায় মন এমন অবশ হয়ে ওঠে যে তার মুগ্ধতা কাটানো ভার। কিন্তু আরো গভীরে যেতে যেতে বুঝতে পারা যায় সে নিতান্তই ভুল ছিল। উন্নতমানের তঞ্চকতা ছাড়া সে আর কিছুই নয়। আজ মিঞা মল্লারের যথার্থতা বোঝাতে যদি আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরের বৃষ্টির রেকর্ডের খাতা বের করতে হয় তবে তা আবহাওয়া দপ্তরের লজ্জা নয়, সে লজ্জা মিঞা মল্লারের। মিঞা মল্লারের আবেদন রসিকের কাছে। অরসিকের কাছে তার মাহাত্ম্য বোঝাতে গেলেই অমন ফাঁকির আয়োজন করতে হয়। ফল হয় এই, একদিন সে ফাঁকি ধরা পড়েই, তখন সে অরসিকের সে রসধারায় আসার পথটা চিরকালের জন্য বন্ধ হয়। কারণ সে ভেবে বসে এর পুরোটাই হয়ত বুজরুকি।
তাই মানুষের হৃদয়ে করুণা, প্রেম আর সত্যের আহ্বান জানাতে বড় বড় সন্ত মাহাত্মার কোনোদিন সংখ্যাতত্ত্বের দ্বারস্থ হতে হয়নি। বরং সংখ্যাতত্ত্ব তাদের বিরুদ্ধেই সাক্ষ্য দিয়েছে চিরটাকাল। সে বড় গলা করে বলতে চেয়েছে ওই সব দুর্বলতা, ছাড়ো! স্বার্থই একমাত্র নীতি এ জগতে বাঁচতে।
তবু সে মহাত্মারা তাঁদের অনুভূত সত্যে অটল থেকেছেন, সে প্রমাণের জোরে না। সে তাঁদের চরিত্রের জোরে, যে চরিত্র আগুনের মত উজ্জ্বল আর জলের মত কোমল। তবে গিয়ে মানুষ নীরবে তার পাশে দাঁড়িয়েছে। নিশ্চিন্তে ঘুমুবে বলে নয়, সে আগুনে পুড়ে নিজেকেও সার্থক করবে বলে। সে মহাত্মারা অত্যন্ত বড় কথা অত্যন্ত বড় করেই বলেছেন, মানুষকে ফাঁকি দিয়ে তার কাছে সহজলভ্য করে ব্যবসা করার জন্য নয়! তাঁরা যুগে যুগে এসে বলেছেন, তোমার নিজের মধ্যে এক পরম সত্য আছে। যাকে প্রেমে চেনো, বোধে চেনো। মুক্ত হও, আনন্দিত হও। তুমি যত স্বার্থত্যাগ করবে তত সে তোমার মধ্যে শক্তিশালী হবে। "বীজটা মরলেই গাছটা হবে"। তাই এই কথাটাই চিরটাকালের সত্য কথা হয়ে রইল - স্বার্থত্যাগ করো। কাঁচা আমি ত্যাগ করো; ছোটো আমি ত্যাগ করো; ভালোবেসে ত্যাগ করো; বোধের আলো জ্বেলে ত্যাগ করো; সেবায় ত্যাগ করো। অল্প অল্প করে শুরু তো করো, দেখবে ভয় কমছে, বিকার কমছে। তুমি নিজেই বুঝবে তুমি ঠিক পথে কি বেঠিক পথে। বাঁচতে গিয়ে মরার রাস্তায় হেঁটো না। স্বার্থপরতার রাস্তা মরার রাস্তা।
হ্যাঁ গো, এই কথাটা বুঝতে প্রতিষ্ঠান লাগে? নিয়মনীতি লাগে? মানুষ নিজেকে ফাঁকি দেওয়ার অজস্র কৌশল বার করে। আমাদের অজস্র দুর্বলতা। ভয়, অনিশ্চয়তা। সবই সত্য। তবে সেগুলোর কাছে আত্মসমর্পণ কোনোদিন সেগুলোর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার পন্থা হতে পারে না। যতই তাকে সোনার শিকলে বাঁধি না কেন। অবশেষে সবটাই ফাঁকি।
"যে করেই হোক” - কথাটাতে আমার খুব অসুবিধা লাগে। “end justifies the means” বা "সব ভালো যার শেষ ভালো” কথাটা আর কোথায় খাটে আমি জানি না, কিন্তু এই আত্মোপলব্ধির পথে খাটে না। সঠিক উপায় ছাড়া সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না। আর এক্ষেত্রে তো পথই নেই। truth is a pathless land -- এ এককালে কবীরজি বলেছিলেন, হাল আমলে জে কৃষ্ণমূর্তি বললেন।
এটা অভ্যাসের কথা না, পুনরাবৃত্তির কথা না। তাগিদের কথা। প্রাণের তাগিদের কথা।