Skip to main content
 
 
      সমস্ত মঙ্গলের উৎস কি? ধর্ম বলবে ঈশ্বর। সমস্ত অমঙ্গলের উৎস কি? স্পষ্ট উত্তর নেই। কেউ বলবে শয়তান, কেউ বলবে অজ্ঞানতা, কেউ বলবে ঈশ্বরের লীলা।
      দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরগুলোর মধ্যে প্রথম আর দ্বিতীয় কারণটার একটা যুক্তি আছে। কিন্তু শেষেরটার কোনো যুক্তি নেই। ওটা চালাকি। 'লীলা' শব্দটার অন্য অর্থ - এর কোনো কারণ খুঁজতে যেও না। অনেকে 'লীলা' শব্দের অর্থ করেছে ইংরাজিতে 'প্লে'। এখানে শব্দের খেলা হচ্ছে একটা। আমি যখন বলছি 'লীলা' আর 'প্লে' একই কথা তখন বোঝাতে চাইছি এর মধ্যে তেমন কোনো যৌক্তিক গুরুত্ব নেই। কিন্তু যখনই বলা হবে যে, সে না হয় বুঝলাম লীলা মানে 'প্লে'। কিন্তু ভায়া, প্লে-র তো একটা নিয়ম থাকে, তোমার 'লীলা'র নিয়ম কি? 
      নেই। উত্তর নেই। তবে অমঙ্গলের উৎস কি? কেউ বলছে স্বার্থপরতা, কেউ বলছে এটাই স্বভাব মানুষের, কেউ বলছে এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তবে উৎস কি? জানা নেই। অমঙ্গল যে আছে সে নিয়ে কোনো সংশয় নেই যদিও। কিন্তু কেন আছে তার কোনো কারণ আমরা জানতে পারি না। 
      অবশ্যই এই অমঙ্গলের কারণ মনুষ্যঘটিত। আরো অনেক অনেক কারণ আছে যার কোনো অর্থ নেই। দুর্ভাগ্য বলে দেগে বসে থাকি। ভক্তের সান্ত্বনা - ঈশ্বরের ইচ্ছা। অভক্তের? নেই। কোনো সান্ত্বনা নেই। সে অবশ্য একদিকে ভালো। মিথ্যা সান্ত্বনার উৎস খোঁজার চাইতে মনকে এই বলিয়ে নেওয়া ভালো, কোনো সান্ত্বনা নেই।
 
      সত্যিই কি নেই? আছে। মানু্ষের অন্তরে একটা মানস সরোবর আছে। তীর্থক্ষেত্র আছে। শান্তির দিকে যাওয়ার স্বাভাবিক ঝোঁক আছে। যদি রাশ ছেড়ে দেওয়া যায় তবে দেখা যায় মন কি করে করে নিজেকে ধীরে ধীরে শান্ত করে নিয়েছে। তার শোক আর ক্ষুব্ধ নয়। তার ক্ষতির ক্ষত আর জ্বালাময়ী নয়। তার অভিমান আর তপ্ত নয়। যদিও সবগুলোই আকারে ইঙ্গিতে তার মধ্যে রয়ে গেছে, কিন্তু সে সামঞ্জস্যে এসে পৌঁছিয়েছে। একে তাকে ডেকে গাল পাড়ছে না, অভিশাপ দিচ্ছে না, পাথরে মাথা ঠুকছে না। আবার সবার সাথে হাঁটার জন্য পা বাড়িয়েছে। 
      এইখানেই অমঙ্গলের পরাজয়। সে মঙ্গলের আবিষ্কারেই যে সব সময় হয়েছে তা তো নয়! নিজেকে শূন্য করেই হয়েছে বেশি। মানুষ আজ আর স্বর্গের গল্প, নরকের গল্প বিশ্বাস করে না, কিন্তু নিজের মধ্যে সেই সরোবরের খোঁজে বাইরে এর-তার কাছে দৌড়ের তার আর শেষ নেই। একদিন আগুন, বাতাস ইত্যাদিকে ঈশ্বর মেনেছিল। আজ মানুষকে ঈশ্বর বানিয়ে নানা গুরু, সম্প্রদায়, ধর্ম তৈরি করে দেওয়াল তুলে তুলে বসে আছে। গোড়ার কথাটা আবার ভুলে যাচ্ছি, আমার সমস্ত শোকের, ক্ষতির, অমঙ্গলের সান্ত্বনা আমার নিজেরই অন্তঃস্থলে। যদি জেদ ছেড়ে দিই। যদি বিশ্বাস করি আমার অস্তিত্ব অগুনতি মানুষের অস্তিত্বের থেকে কোথাও বিশেষ কিছু নয়। তবে সান্ত্বনা আপনিই মেলে। চারদিকে চেয়ে দেখি আমার এ বিপত্তি নতুন কিছু নয়, "মান্ধাতারই আমল থেকে চলে আসছে এমনি রকম— / তোমারি কি এমন ভাগ্য বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম!"
      আমি সমতলে দাঁড়ালে, আমার হৃদয়ও সমতলে দাঁড়ায়। আমি সবার মাঝে দাঁড়ালে আমার হৃদয়ও সবার মাঝে দাঁড়ায়। তখন বাইরে থেকে কাউকে আমদানি করতে হয় না, "ওগো আমায় শান্তি দাও" বলে, নিজের মধ্যেই মনের নড়াচড়ার শব্দ পাওয়া যায়। বেশ বোঝা যায় সে গড়িয়ে গিয়ে কোথাও একটা দাঁড়াবার জায়গা খুঁজছে যেটা সেই সময়ের জন্য তার সব চাইতে নিশ্চিতস্থল। সেখানে সুখ নেই হয়ত, কিন্তু সান্ত্বনা আছে। শোকের অবসান আছে। সে অংশটুকুকে বাদ দিয়ে আমি হইনি, আমি আমিই আছি, আমার সান্ত্বনায়, আমার নিজেকে শান্ত করার জন্মপ্রাপ্ত ক্ষমতায়। শুধু তাড়া না দিলেই হল জেদের বশে।