সৌরভ ভট্টাচার্য
5 June 2019
আমাদের একটা দিবাস্বপ্ন আছে। যে স্বপ্নটার বিশেষ নির্দিষ্ট কোনো আকার নেই। কিন্তু আছে। আমাদের সিনেমা, মানে মূলস্রোতের সিনেমা, অন্যশব্দে যাকে বাণিজ্যিক সিনেমা বলে থাকি, তেমন সিনেমা, তেমন সিরিয়াল, তেমন গল্প – আছে। বাস্তব আর দিবাস্বপ্নের মধ্যে কল্পনা একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে থাকে। কল্পনা ভবিষ্যতকে আংশিক দেখাতে, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করতে সাহায্য করে। কিন্তু দিবাস্বপ্নের সে দায় নেই। সে উইশফুল থিংকিং। তার সুখ-দুঃখ কাল্পনিক জগতে ঘুরে বেড়ায়। তার বাস্তব হয়ে ওঠার দায় নেই। ‘ভাবের সাথে ভবের মিলন’ হল কি হল না সেটা যেন খুব একটা বড় ব্যাপার নয়, বড় ব্যাপার আমার সুখ-দুঃখের কম্ফোর্ট জোনটা। আমার দিবাস্বপ্ন।
দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী যখন বলেন কাল থেকে সমস্ত মহিলা বিনা পয়সায় যাতায়াত করবেন, সেটি তিনি মহিলাদের অপমান করছেন বুঝতে পারেন না। দুর্ভাগ্য অনেক মহিলাও বুঝতে পারেন না। অযাচিত ছাড় দেওয়া মানেই ধরে নেওয়া হয় মহিলাদের কোনো আত্মসম্মানবোধ নেই। তারা সব সময় নানা সুবিধাকাঙ্ক্ষী। যেমন মহিলা আসন, মহিলা কামরা, মহিলা লাইন, মহিলা ব্যাঙ্ক, মহিলা থানার মত মহিলা ছাড়। কিন্তু ছাড়ের অর্থ কি? কারণ কি? যদিও তাদের মত কিছু যুক্তি আছে। সে যুক্তিতে তথ্য আছে কিন্তু সম্মানবোধটি নেই। মানুষ শুধু পরিসংখ্যান বা বাজেট নয়, মানুষের সব চাইতে বড় কথা তার সন্মানবোধ, যা অর্থের উপর নির্ভর করে না, নিজের বোধের উপর নির্ভর করে। ধরেই নেওয়া হচ্ছে যে ছাড় পেলেই তা নেওয়া হবে। নিশ্চই নেওয়া হবে। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানি অনেক মহিলা এতে কোনো অসুবিধা দেখবেন না, বেশি ভাবছেন বলে হয়ত গালও পাড়তে পারেন। তবু শারীরিক ক্ষমতার পার্থক্য আছে বলেই আত্মসম্মানের পার্থক্য থাকবেই এমন কোনো যুক্তি হয় কি? তাই অনেক জায়গায় সে পার্থক্য অনুযায়ী বিধিব্যবস্থা থাকলেও এক্ষেত্রে তা গ্রহণযোগ্য কি?
কিন্তু তবু আমরা বিশ্বাস করি আমরা এতে জনতার সায় পাব। মুখ্যমন্ত্রীর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন অতিবড় নির্বোধও তুলবে না। তবু তিনি এভাবে ভারতের মহিলাদের ভাবতে দ্বিধা করেন না। যদি বলা হয় আমরা এমনই, তাই তিনি তার সিদ্ধান্তে বাস্তববোধ দেখিয়েছেন, তবে বলতে হয় যে মানবিকবোধটা বাস্তববোধের চাইতে বড় বলেই মানুষ মানুষ। সুবিধাবাদী হওয়াকে সে নীচু চোখে দেখে। কিন্তু অবশেষে জয় হবে জনরঞ্জন করা লঘু সিদ্ধান্তের, বিবেচনাগত কঠিন সিদ্ধান্তের নয় – এমনই ধারণা সমস্ত অল্পদর্শী মানুষের। আদর্শহীন রাজনীতির।
এ গেল এক। যে কথা বলছিলাম। আমাদের এক দিবাস্বপ্ন আছে। আমরা আমাদের বিবেকের ভার পুলিশের হাতে দিয়ে, চেকারের হাতে দিয়ে, প্রতিবেশীর সতর্কতার হাতে দিয়ে আপন চাতুরীর মাধুরীতে মগ্ন হয়ে জীবনযাপনে অভ্যস্ত। কারণ আমাদের বিবেকবোধ নেই। আমরা জানি যে কারণে চাকরি তথা পরীক্ষায় সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে, সেই কারণে বা সেই অর্থনীতিতে পিছিয়ে পড়া শ্রেণী না হলেও আমার সেই সুবিধায় চাকরি নিতে বিবেকে বাধে না। আমার নীতির ভারত, আমার সংহতিপূর্ণ ভারত আমার দিবাস্বপ্নের দেশ। আমার সেখানে কর্তব্য কিছু নেই, অধিকারবোধ আছে। আমি দু'কিলোমিটারের পথ সাইকেলে বা হেঁটে যাই না, বাইক লাগে, তাতে তেলের অপচয়, পরিবেশ দূষণ আমাদের দায়ের মধ্যে পড়ে না। আমি যত্রতত্র হর্ণ দিই, যত্রতত্র পানের পিক ফেলি, প্লাস্টিক ব্যবহার করি হাজারবার বারণ সত্ত্বেও, সিগারেটে সুখ টান দিই – কারণ আমার একটা দিবাস্বপ্নের দেশ আছে। সেখানে সব কিছু পার্ফেক্ট, সেখানে বিনা কর্তব্য সম্পাদনে সুখের প্রতিশ্রুতি, সেখানে দুর্যোগ নেই, সেখানে দুর্ঘটনা নেই।
আমাদের আরেকটি দিবাস্বপ্ন আছে। আতঙ্কের দিবাস্বপ্ন। আমাদের মাইনরিটি সম্প্রদায়, আমাদের ভাষার আত্মমর্যাদা, আমাদের সংস্কৃতির শুদ্ধতা, আমাদের যৌনজীবনের উপাখ্যান – সবই সেই নেগেটিভ দিবাস্বপ্নের ক্ষেত্র। আমরা পদে পদে শঙ্কিত - ‘সদাই মরে ত্রাসে- ঐ বুঝি কেউ হাসে!’-র মতন। আমাদের সে ত্রাসও দিবাস্বপ্নের ত্রাস। যা বাস্তবে নেই, তা ভয়ংকরভাবে কল্পনায় থাকে। এ যেন ‘জলসাঘর’-এর জমিদারের বিপন্ন আত্মম্ভরিতার মত। তার সমস্তটা তার মাথায়। যেখানে শুকনো কাঠ যত বেশি সেখানে আগুন লাগার ভয়ও তত বেশি। আমরা সেটা জানি। কিন্তু যদি বলি শুকনো কাঠের একটা পরিসংখ্যান কর দেখি? কেউ এগোবে না। কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে না। কয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে প্রমাণ করানোর চেষ্টা হবে সমগ্রচিত্র হিসাবে। এর জ্বলন্ত উদাহরণ সদ্য টাইমস ম্যাগাজিনে আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে দুই মেরুতে রাতারাতি অবস্থান পরিবর্তন। তারাও জানে ভারতীয়দের একটা দিবাস্বপ্নের দেশ আছে। সেখানে আগুন লাগানো বা পুষ্পবৃষ্টি যাই করা যায় – তারা তা গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু সত্যিই এতটাই ভয়, এতটাই আতঙ্ক, এতটাই বিপন্নতা আমার চারপাশে? নয়তো। আমার দিবাস্বপ্নের অনুকূল খবর, প্রচার, রঙীন উপস্থাপনা আমাকে যে অবাস্তব জগতে ঠেলে দেয়, আমাকে যেভাবে বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন করে, যে পোস্ট ট্রুথের জন্ম দেয় – সেকি সত্যি সত্যি আমার মঙ্গলের জন্য?
আমার মঙ্গল সেদিন হবে যেদিন আমি আমার এই দিবাস্বপ্ন থেকে বেরিয়ে এসে আমার দায়িত্ব বুঝে নেব। আমি কোনো বর্ডারে হয়ত যুদ্ধে যাব না। কিন্তু আমি টিটি-কে লুকিয়ে সিগারেট খাব না, আমি বিনা টিকিটে যাত্রা করব না, আমি মিথ্যা রটনা না তো রটাবো, না রটাতে দেব, আমার কাছে আমার মাথা নীচু হয় এমন কোনো কাজ করব না। সেই হবে আমার স্বপ্নের ঘোর থেকে বেরিয়ে আসা।
ভারত ধর্মের দেশ – মিথ্যা কথা। ভারত দর্শনের দেশ। ভারতে নানা দর্শন আছে। সেই দর্শনের নানা অপব্যাখ্যায় ছেয়ে গেছে আমাদের মাথাগুলো। আমাদের আবার সেই মূল দর্শনগুলোর কাছে ফিরতে হবে। কারুর ব্যাখ্যা, কারুর উপলব্ধির উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজের সাধারণ বুদ্ধিতে বিচার করে দেখতে হবে কতটুকু আজকের দিনে আমায় মঙ্গলের পথে নিয়ে যায়। কতটুকু সবার সাথে বাঁচতে, বেড়ে উঠতে সাহায্য করে, সেটুকু গ্রহণ করে বাকিটা নির্মোহের সাথে বর্জন করতে হবে। কারণ ওই যে বললাম, ভারত নানা দর্শনের দেশ। দর্শন মানেই সত্যকে আলিঙ্গন, মিথ্যাকে বর্জন। সত্যতে আস্পৃষ্ট মিথ্যাকে চেনাই বিবেচনা। আমাদের পোস্ট ট্রুথ থেকে বাঁচার উপায়। আমাদের দিবাস্বপ্ন থেকে জাগার মন্ত্র।