Skip to main content

 

না হয় তাই হল। না হয় কিছুই মনের মত হল না। না হয় সবাই এগিয়ে গেল। না হয় আমিই রয়ে গেলাম একা। সম্পূর্ণ একা।

যখন আমি সম্পূর্ণ একা হয়ে যাই, নিঃশব্দে খোলা আকাশের নীচে এসে দাঁড়াই। কিম্বা দরজায় খিল দিয়ে চোখটা বন্ধ করে চুপ করে বসি।

তারপর খুঁজি, এই যে আমার একাকীত্ব, একে অনুভব করছে কে? যে অনুভব করছে সে আমার খুব কাছে বসে, কি এক অনির্বচনীয় আলো আমার মধ্যে জ্বেলে দিয়ে বলছে, এই হল তোমার একাকীত্বের অনুভব। এই যে বলছে, তবে সে কে?

সে আমার মধ্যের আরেক আমি, গোটা আমি। সব কিছু মিলিয়ে গোটা একটা আমিই তো আছি। কিন্তু সে আমিটাকে, মানে গোটা আমিটাকে খুঁজে পাওয়া ভারী শক্ত। সে এক খেলা। খণ্ড খণ্ড আমি যখন নিজেদের মধ্যে লড়াই করে মরছে, কিছুতেই একটা বোঝাপড়ায় আসতে পারছে না, তখন এই গোটা আমিটা সে সবকে সামাল দিয়ে চলেছে, অসীম ধৈর্যে। নিজের দিকে একটু ভালো করে তাকালেই বেশ বোঝা যায়, এই ভালোবাসা, রাগ, অভিমান, অসন্তোষ ইত্যাদি ইত্যাদিতে গড়া, এই টুকরো টুকরো আমিগুলোকে ছাড়িয়ে আরো কিছু নিশ্চয়ই বাকি আছে। এইতেই সব ফুরিয়ে যায় নাকি? তাহলে হিসাবে মিলবে না যে!

সেই গোটা আমিটাকে খুঁজতেই মাঝে মাঝে একাকীত্বের অনুভবটা ভালো। খুব দরকারি। এ যেন আলমারি গোছানোর মত। মাকে দেখতুম, মাঝে মাঝে সব জামাকাপড় নামিয়ে, ঘেমে-নেয়ে আলমারিটা গোছাচ্ছেন, আর বলছেন, উফ, কি করে রেখেছিস, শুধু হাগতে বাকি রেখেছিস, দরকারে একটা জিনিসও খুঁজে পাবি

নিজে যখন ভীষণ এলোমেলো হয়ে যাই। সব আছে, কিন্তু মনে হয় যেন আমার ভিতরে কোথাও একটা তাল কেটে গেছে, সুর উঠছে না। আমার মায়ের ওই আলমারি গোছানোর দৃশ্যটা চোখে ভাসে। মনে হয় সত্যিই তো, নিজেকে এত এলোমেলো করে ফেলেছি যে এখন দরকারের সময় মন বিভ্রান্ত, অনুভব ধোঁয়াশাময়। দূর দূর, এমন করে নিজেকে নিয়ে বাঁচা যায়? জগতে একটা জিনিসও তো নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই, কিন্তু নিজের নিজেকেও যদি নিজের অবহেলায় হারাই, তবে তো দাঁড়াবার জায়গা থাকে না।

অগত্যা আলমারি গোছাতে বসি। খণ্ড খণ্ড আমিগুলোকে আবার কুড়িয়েবাড়িয়ে এনে, তাদের গায়ে লেগে থাকা ক্ষোভ, অভিমান, দুরাশার হতাশাদের ঝেড়েঝুড়ে, বাবা-বাছা করে বুঝিয়ে বাঝিয়ে আবার ঘরে তুলি। এ সম্ভব হয় এই গোটা আমির হাতে তৈরি এক পরমান্নের জন্য। সে পরমান্নের নাম, আত্ম-করুণা। সে পরম যত্নশীল। ধৈর্যশীল, মমতাময়। তার তাড়া নেই কোনো। তার সামনে শুধু আমিই আছি।

এর জন্য প্রথম শর্তই হল একটু সরে দাঁড়াও, একটু একা হও। সমস্ত রকমের দোষদৃষ্টি মুক্ত হও। একাকীত্বকে মোহের আবরণে ঢাকে বিষম বিষাক্ত এই দোষদৃষ্টি। একে সরাও, বিশ্বাস করো তুমি তোমার হাজার একটা খণ্ড খণ্ড আমি হারিয়ে ফেললেও, ওই গোটা আমিকে কোনোদিন হারাতে পারবে না। ওটা হয় না। আকাশ যেমন তার নীলকে হারায় না, এও তেমন। আলমারি থেকে কত জামাকাপড় সরে যায়, আবার কত জামাকাপড় নতুন আসে। এও তেমন। খণ্ড খণ্ড যে আমিগুলো সময়ের নানা খণ্ডে বুদবুদের মত জন্মেছে, তারা তো মিলাবেই, সময় হলে। কিন্তু যে জলাধারে এই নিত্যনতুন বুদবুদের জন্ম, সে হারিয়ে যায় না। সে নিত্য, শ্বাশত আমি। গোটা আমি। কোনো জোড়াতাপ্পি দিয়ে বানানো না সে। সে গোটা আমি বানানো অসীম করুণায়। নইলে নিজের এত এত ত্রুটিকে সহ্য করেও, মার্জনা করেও, কার করুণায় আবার নিজের মুখোমুখি হওয়ার সাহস পেয়ে চলেছি? সে আমার এই গোটা আমির। যে আমায় সবটা নিয়ে বোঝে। তাই এত গভীর সে, এত আপন আর এত নির্ভরতার জায়গা। তাকে খুঁজে পেতেই হবে। সে-ই পরম শান্তি। স্থির আনন্দ। গভীরতম শাশ্বত আশার বাণী - আমি আছি।

সে সত্যই আছে। আমার হাজার একটা ত্রুটিযুক্ত খণ্ড খণ্ড আমিকে একত্রে নিয়ে, সে আমারই গোটা আমি। শুধু যে করেই হোক, দোষদৃষ্টি মুক্ত হও। আগল সরে যাবে। মেঘ কেটে যাবে।