Skip to main content

শান্ত থাকা যায় কি করে? এ প্রশ্নটা বড় ঘোরেল। 'কিছু করা' আর 'শান্ত থাকা' কি এক বস্তু? অনেকে জপ-ধ্যান করে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করেন দেখেছি। আমিও করে দেখেছি। ওতে কি কাজের কাজ কিছু হয়? আমার মনে হয় না। এ অনেকটা সিনেমা দেখার মত। যতক্ষণ দেখছি, মনটা একাগ্র, স্থির। যেই হল থেকে বেরোলাম, যেই কে সেই। কিছুক্ষণের জন্য মনের বিরাম কি তবে শান্ত হওয়ার লক্ষণ?
        গোলমালটা হল, একাগ্র হওয়ার চেষ্টা করা আর ধ্যানস্থ হওয়ার চেষ্টা করা এক বস্তু তো না। একাগ্র হওয়ার চেষ্টাটা একটা যান্ত্রিক প্রচেষ্টা। তাতে কিছু লাভ নেই, তা নয়; তবে তাতে আখেরে কিছু লাভ বিশেষ একটা হতে দেখিনি। বাস্তব থেকে সরে আসার জন্য যা কিছু করি, তা অত্যন্ত আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গিয়ে মনঃপীড়া, উদ্বেগকে আরো প্রবলতর করে তোলে। তখন নিজের মুক্তি, নিজের পূণ্য, নিজের ভবিষ্যতের সুখ-নিরাপত্তা ইত্যাদির ভাবনারা একটা ভুলভুলাইয়া তৈরি করে চরকির মত ঘোরায়। সেই যে গানে আছে না, "আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া ঘুরে মরি পলে পলে"। অর্থাৎ টকের জ্বালায় ঘর ছেড়ে তেঁতুল তলায় বাস। সংসারের স্বার্থচিন্তা তখন পোশাক বদলে ধর্মীয় স্বার্থচিন্তায় পর্যবসিত। এ আরো সুক্ষ্ম, ফলে শিকল আরো মজবুত, ছলনা আরো গভীর। শান্তি আসবে কোথা থেকে?
        আরেকটা জটিল কথা - ঈশ্বরলাভ। কথামৃত পড়ে, 'ঈশ্বর লাভ' আর 'ঈশ্বর দর্শন' কথাদুটো ইদানীং খুব চলতি। দার্শনিক বইয়ের মধ্যে ভুরিভুরি সেইসব কথা। ধোঁয়া, ধোঁয়া... ছায়া ছায়া সেই শব্দের মোহে মানুষ ছুটে বেড়াচ্ছে, আজব আজব খেয়ালে নিজেকে ভুলিয়ে রাখছে। আজ সমাজের কাজ, কাল জপযজ্ঞ, পরশু নাম-সংকীর্তন ইত্যাদি সব খেয়ালের তাড়না। ভিতরে কোনো বোধ জন্মেছে তার জন্যে যে করা হচ্ছে তা না, করা হচ্ছে একটা অনুকরণ, কিছুটা আত্মশ্লাঘা, কিছুটা 'কিছু একটা করতে হবে' ইত্যাদির জন্য। 'বড় কাজ' করার মোহ অন্যান্য যে কোনো মোহের চাইতে সাংঘাতিক মোহ। কিন্তু এ সব করেও সারাটা দিনের শেষে শূন্যতা।
        সত্যি কথাটা হল নিজেকে ফাঁকি দিয়ে লাভ নেই। ভাবের ঘরে চুরি থাকলে সব সঞ্চয় ব্যর্থ। নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে - আমার এত আটুপাটু কিসের? এ চঞ্চলতা না ব্যাকুলতা? দেখা যাবে প্রায় সবটাই চঞ্চলতা। একঘেয়ে জীবনের হাত থেকে বাঁচবার জন্য একটু অন্যরকম কিছু দিয়ে নিজেকে ভুলিয়ে রাখার কৌশল। এতে প্রচণ্ড ক্ষতি। মানুষের সবচাইতে বড় অসহায়তা হল সে নিজেকে বেশিদিন ভুলিয়ে রাখতে পারে না। কঠোর বাস্তবটার মুখোমুখি হতে সে যতটা দৌড়ায় তত পথটাই বেড়ে যায়... "এড়িয়ে তাঁরে পালাস না রে, ধরা দিতে হোস না কাতর / দীর্ঘ পথে ছুটে কেবল দীর্ঘ করিস দুঃখটা তোর"। নিজেকে মিথ্যা বলার হাজারো কৌশল ধীরে ধীরে রপ্ত হয়। আমার সাজানো বানানো ভগবান, যিনি নাকি তার সারা বিশ্বের সব কিছু ছেড়ে আমারই খিদমদগিরি করার জন্য আছেন, তার ঠেলায় জীবনের যে গভীরতম সত্য আর তার উপলব্ধি, যাকে ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না, সে আসার আর পথ পায় না। সত্যের পথ আগলে বসে আমারই তৈরি আমার সত্য। যা না দেয় বল, না দেয় জীবনের নির্মম সত্যগুলোর মুখোমুখি হওয়ার সাহস, আর না তো সে আমায় করে মুক্ত আমার আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনার আবর্ত থেকে। চরম ক্ষতি আরো আছে - সে হল দু'হাত ছেড়ে ভালোবাসার ক্ষমতা সে কেড়ে নেয়। কারণ সঠিক অর্থে ভালোবাসা কোনো স্বার্থকেন্দ্রিক হৃদয়ে জন্মাতে পারে না। সেখানে ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতার পাঁকে কি করে জন্মাবে সেই সংসারে একমাত্র সঞ্জীবনী - ভালোবাসা? সেখানে গুরু, মন্ত্র, কৌশল, রীতিনীতি, আমার ভগবান - ইত্যাদির পাঁচিলের পর পাঁচিল গাঁথা। সেখানে সারাদিন আমার আগলানোর চেষ্টা - আমার সংসার, আমার সঞ্চয়, আমার পূণ্য, আমার ইহকাল-পরকাল। নিজেকে ছেড়ে দিলাম কই? তাই ছোটো সংসারে জমল অনেক, বড় সংসারে রইলাম ভিখারি হয়ে। শান্তি আসবে কোথা থেকে?
        তবে শান্তি আসে কি করে? কিছু করে নয়। নিজের মধ্যে যতক্ষণ না ঠিক ঠিক সমন্বয় হচ্ছে, ততক্ষণ শান্তির কোনো সম্ভবনা নেই। শান্তি কোনো ক্রিয়ার প্রত্যক্ষ ফল নয়। শান্তি পরোক্ষ ফল। শান্তি নিজের মধ্যে নিজের একটা গতিময় অবস্থা - আমার সমস্ত শক্তির সম্যক অবস্থান, অব্যবস্থাহীন অবস্থান। আমার মধ্যে শূন্যতা আছে, নিঃসঙ্গতা আছে, তার থেকে পালিয়ে কোনো ফল নেই। তার মুখোমুখি হতেই হবে। সে শূন্যতা, নিঃসঙ্গতা হাজার মানুষের ভিড়ে থাকলেও আমার মধ্যে থাকবে। তার ভিতর দিয়েই যেতে হবে। তবে গিয়ে যে সত্য আমাকে ধরে রেখে আমাকে নিয়ে চলছে, তার সাথে সাক্ষাৎ হবে। তবে গিয়ে শান্তি আসবে। কারণ সে সত্য আমার নিজের বানানো নয়, সে আমার 'আমি'-র ধারক-বাহক। তখনই আমি মহাপুরুষদের বাণীর মর্মার্থে প্রবেশ করতে পারব। তাকে মুখস্থ রেখে চলতে হবে না। আমি আলোকিত হব। অশান্তির মধ্যে শান্ত হব। চেষ্টা করে না। বরং আত্ম-সম্মোহনের চেষ্টাগুলোকে দূরে রেখে। নিজেকে বইপড়া আত্মা জেনে না, নিজেকে জানতে পেরে যে, আমি আর সবার আমির সাথে যুক্ত একটা সত্তা। নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবাটাই ছিল অজ্ঞতা। ভগবান তখন আমার হয়েও সবার, আমিও তখন আমার হয়েও তাঁর, তথা সবার।
        তখন আর ভালোবাসা অভ্যেস করতে হবে না। তখন মন আপনি শান্ত। প্রার্থনা তখন দিগন্তব্যাপী - সর্বে ভবন্তু সুখিন, সর্বে সন্তু নিরাময়া - সকলে সুখী হোক... সকলে আরোগ্য লাভ করুক।