সৌরভ ভট্টাচার্য
12 December 2016
”কেউ যখন বুঝে যায় না স্যার, যে তার উপর আমার দুর্বলতা আছে, অমনি সে ঘ্যাম দেখাতে শুরু করে। ভালো করে কথা পর্যন্ত বলে না। কথায় কথায় অপমান করে, জানে তো উল্টে আমি কিছু বলব না তাকে..."
বলতে বলতে তার সারা মুখে ছেয়ে এলো বাদল মেঘ, চোখের কোণায় পদ্মপাতার উপর পড়ে থাকা বৃষ্টিবিন্দুর মত বড় বড় দু'ফোঁটা জল। কত বয়েস হবে মেয়েটার? এখনো কুড়ির থেকেই কয়েক ঘর পিছিয়ে, এত গভীরের মনস্তত্ত্ব বুঝল কি করে? তাকে চিনি বলেই জানতাম। তার পরীক্ষার খাতা, নিয়মিত আসা-যাওয়া, দুষ্টুমি করা, বকা খেয়ে চুপ করে থাকা, পরক্ষণেই মিটিমিটি হাসা মাথা নীচু করে - এই তো ছিল ওর সম্পূর্ণ পরিচয় আমার কাছে। আজ মনে হল, শুধু ফুলটার পাঁপড়িগুলোর বিকাশের খবরটুকুই জানতাম, তার কেন্দ্রে যে তার মধ্যে পরিণত মকরন্দের আধার পূর্ণ হয়েছে, সে খবরটা আসেনি এতদিনে।
তারপরের প্রশ্নটা আরো সাংঘাতিক - "আপনার হয়নি এরকম কখনো স্যার?”
বুঝুন স্যার। এ জটিল মাথা নয় যে কথার প্যাঁচে কথা ঘুরিয়ে পালানো যাবে। সামনে দু'জোড়া সরল চোখ উত্তরের অপেক্ষায়। সরল কিন্তু নির্বোধ নয়, মনে রেখো। সোজা রাস্তাতেই হাঁটতে হয়, এ বিশ্বাস মন থেকে মুছে যায়নি ওর এখনো, স্যার খুঁজছেন চতুর উত্তর। পেলেন না স্যার।
একটু হেসে বললাম, "হয় তো..." ততক্ষণে তার মনের বাঁক ঘুরে কথা অন্যখাতে গিয়ে পড়েছে। বলল, "যাক গে, যা খুশী করুক, আমি তো ওকে কষ্ট দিইনি কখনো! আমি আসি। এসব কথা বলবেন না প্লিজ ওকে, আমার এখন তত কষ্ট হয় না আর।"
চলে গেল। স্যার বসে রইলেন একা, ফাঁকা ক্লাসঘরে। কে ছিল শিক্ষার্থী আর কে ছিল শিক্ষক?
তারপরের প্রশ্নটা আরো সাংঘাতিক - "আপনার হয়নি এরকম কখনো স্যার?”
বুঝুন স্যার। এ জটিল মাথা নয় যে কথার প্যাঁচে কথা ঘুরিয়ে পালানো যাবে। সামনে দু'জোড়া সরল চোখ উত্তরের অপেক্ষায়। সরল কিন্তু নির্বোধ নয়, মনে রেখো। সোজা রাস্তাতেই হাঁটতে হয়, এ বিশ্বাস মন থেকে মুছে যায়নি ওর এখনো, স্যার খুঁজছেন চতুর উত্তর। পেলেন না স্যার।
একটু হেসে বললাম, "হয় তো..." ততক্ষণে তার মনের বাঁক ঘুরে কথা অন্যখাতে গিয়ে পড়েছে। বলল, "যাক গে, যা খুশী করুক, আমি তো ওকে কষ্ট দিইনি কখনো! আমি আসি। এসব কথা বলবেন না প্লিজ ওকে, আমার এখন তত কষ্ট হয় না আর।"
চলে গেল। স্যার বসে রইলেন একা, ফাঁকা ক্লাসঘরে। কে ছিল শিক্ষার্থী আর কে ছিল শিক্ষক?
নিজের ভালোবাসার প্রত্যুত্তর না পেলেও নিজেকে সংযত রাখা যে কি দায় সে ইতিহাস দীর্ঘ। আমার এই হালিসহরেই ক’দিন আগে টিউশান ব্যাচে একজন দ্বাদশ ক্লাসের ছাত্র, এক ছাত্রীকে ছুরির আঘাত করে বসল শুধুমাত্র প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে। এরকম ঘটনার নজির দুর্লভ নয়। বহু সাহিত্য, চলচিত্র এর ওপর সারা পৃথিবীব্যাপী আছে, ভবিষ্যতেও হবে।
ভালোবাসা না, আমি চাইছি আরেকজনের মনোযোগ, attention. তাই না কি? ভালোবাসা আর মনোযোগ ভিক্ষা করা কি এক বস্তু? আমি কাউকে ভালোবাসতেই পারি। এবং এটা বুঝতেও বেগ পেতে হয় না যে, সে মানুষটার আমার উপর সেরকম কোনো আকর্ষণ নেই। অর্থাৎ আমি যে ধরণের গুরুত্ব তার কাছ থেকে পেতে চাইছি তা পাব না। কারণ তার কাছে সেটা স্বাভাবিকভাবে আসছে না।
সঠিক অর্থে ভালোবাসাটা কোনো শর্তনির্ভর না। সেখানে ধারাবাহিক কিস্তিতে মনোযোগ দাবী করাটা অস্বাস্থ্যের লক্ষণ। কোথাও যেন সে তার নিজের ও অপর মানুষটার ভালোবাসার উপর সন্দিহান বুঝতে হবে। তাই বারবার মনোযোগের পরীক্ষা দিতে আহ্বান জানায় তাকে। পরীক্ষা করে দেখে নিতে চায় তার কাছে সে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। এটা অস্বাভাবিক না, স্বাভাবিক, তবে অজ্ঞতাপূর্ণ। আর এটাও মনে রাখতে হবে অজ্ঞতা থাকাটাও স্বাভাবিক। তাকে অতিক্রম করার চেষ্টা করাটাই অস্বাভাবিক, ব্যতিক্রমী। তাই অশান্তি, কলহ, অভিযোগ, ঈর্ষা ইত্যাদি সবই নাকি প্রেমের অঙ্গ হয়ে পড়ে। তাই যাকে নাকি ভালোবাসি মন-প্রাণ দিয়ে, সে আমার দিকে তার ধ্যানজ্ঞান দিয়ে রাখেনি বলে তার গলাতে ছুরি চালাতেও আমার দ্বিধাবোধ নেই। সেটাও তো ভালোবাসাই। আমার ভালোবাসা চাই না, চাই অ্যাটেনশান। পুরোপুরি অ্যাটেনশান। আচ্ছা পুরো না হোক আংশিক, তার সিকিভাগ! তবু অ্যাটেনশানের হিসাব আসবেই আসবে। কারণ অজ্ঞতার একটা নিজস্ব সুখ আছে। ঘুমের মধ্যে যত স্বপ্ন আসে, জেগে থাকলে আসে কই? অজ্ঞতার মত গভীর ঘুম কই আর? সে যদ্দিন পরমায়ু থাকে তার।
এই নিরুত্তর একপক্ষ ভালোবাসাকে তবে বুকে করে বেড়ানো যায় কি করে? বারবার তার কাছে নিজের অসহায়তা বুঝিয়ে? তাকে বারবার নানান ভাবে উত্তক্ত করে, ঘ্যানঘ্যান করে আদায় করেই ছাড়ব ভেবে? অথবা অন্য কোনো কৌশলে বা চক্রান্তে?
এর কোনোটাই নয়। বাচ্চা মেয়েটার উত্তরটা খুব আশ্চর্য লাগল – আমি তো তাকে কষ্ট দিইনি! তবে থাক, আপনি বলবেন না তাকে।
এত শুদ্ধ ভাবটা সে পেল কি করে? অথচ এর বিপরীতটাই তো দেখছি নির্লজ্জের মত নানান ভাষায়, বিকারে আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। অপরজনকে বিব্রত করে, অপদস্থ করে, উৎপীড়ন করে, তার সৌজন্যবোধের যথার্থ সুবিধা নিয়ে, আত্মদাবির ফরমায়েশ চলেই যাচ্ছে চলেই যাচ্ছে। কি ঘৃণ্য পরিণতি ঘটছে। তবে তাও সই, তাও চলুক, তাও পাই।
জেদ মানে ভালোবাসা না। মনোযোগ মানে ভালোবাসা না। আসলে কিছু মানেই ভালোবাসা না। কারণ ভালোবাসা মানে কিছু না। ওটা একটা দাবী না, ওটা একটা ব্রত। সে ব্রত উদযাপনের ভার আরেকজন না নিলে নিজেকেই নিতে হয়। আর যদি সেও সে ব্রত উদযাপনের ভার নেয় সে তো খুব ভালো কথা। কিন্তু না নিলেও সে ব্রত যেন অসম্পূর্ণ না থাকে। তাতে নিজের দীনতার প্রকাশ। অসম্পূর্ণ ব্রতের পাপের জন্ম দেয়। তাই ভালোবাসার সে ব্রতকে সার্থক করতেই হয়। নিজের জন্য। নিজেকে পরিপূর্ণ করার জন্য। আর সে সবই হোক গোপনে। একান্ত গোপনে। সে যেন জানতেও না পারে তাকে ভালোবেসেছিলাম। কারণ যে ভালোবাসা মনে করাতে হয়, সে আধসিদ্ধ চালের মত, না হয় পরিপাক, না হয় বমি। মাঝখান থেকে পেট ব্যাথায় প্রাণ যায়। তখন ভালোবাসা পিট্যুইটারীর কার্য ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। মস্তিষ্কের আরো গভীরের মননের আলো সেখানে পৌঁছায় না। যদিও অজ্ঞতার অন্ধকারে চলার স্বাধীনতা সবার আছে। চিরটাকাল থাকে। তবে সে একটা অন্ধকার থেকে আরেকটা অন্ধকারেই নিয়ে যায় মাত্র। এর বেশি কিছু সে পারে না। একটা কবিতা মনে পড়ছে... তাই দিয়েই শেষ করি –
ভালোবাসা না, আমি চাইছি আরেকজনের মনোযোগ, attention. তাই না কি? ভালোবাসা আর মনোযোগ ভিক্ষা করা কি এক বস্তু? আমি কাউকে ভালোবাসতেই পারি। এবং এটা বুঝতেও বেগ পেতে হয় না যে, সে মানুষটার আমার উপর সেরকম কোনো আকর্ষণ নেই। অর্থাৎ আমি যে ধরণের গুরুত্ব তার কাছ থেকে পেতে চাইছি তা পাব না। কারণ তার কাছে সেটা স্বাভাবিকভাবে আসছে না।
সঠিক অর্থে ভালোবাসাটা কোনো শর্তনির্ভর না। সেখানে ধারাবাহিক কিস্তিতে মনোযোগ দাবী করাটা অস্বাস্থ্যের লক্ষণ। কোথাও যেন সে তার নিজের ও অপর মানুষটার ভালোবাসার উপর সন্দিহান বুঝতে হবে। তাই বারবার মনোযোগের পরীক্ষা দিতে আহ্বান জানায় তাকে। পরীক্ষা করে দেখে নিতে চায় তার কাছে সে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। এটা অস্বাভাবিক না, স্বাভাবিক, তবে অজ্ঞতাপূর্ণ। আর এটাও মনে রাখতে হবে অজ্ঞতা থাকাটাও স্বাভাবিক। তাকে অতিক্রম করার চেষ্টা করাটাই অস্বাভাবিক, ব্যতিক্রমী। তাই অশান্তি, কলহ, অভিযোগ, ঈর্ষা ইত্যাদি সবই নাকি প্রেমের অঙ্গ হয়ে পড়ে। তাই যাকে নাকি ভালোবাসি মন-প্রাণ দিয়ে, সে আমার দিকে তার ধ্যানজ্ঞান দিয়ে রাখেনি বলে তার গলাতে ছুরি চালাতেও আমার দ্বিধাবোধ নেই। সেটাও তো ভালোবাসাই। আমার ভালোবাসা চাই না, চাই অ্যাটেনশান। পুরোপুরি অ্যাটেনশান। আচ্ছা পুরো না হোক আংশিক, তার সিকিভাগ! তবু অ্যাটেনশানের হিসাব আসবেই আসবে। কারণ অজ্ঞতার একটা নিজস্ব সুখ আছে। ঘুমের মধ্যে যত স্বপ্ন আসে, জেগে থাকলে আসে কই? অজ্ঞতার মত গভীর ঘুম কই আর? সে যদ্দিন পরমায়ু থাকে তার।
এই নিরুত্তর একপক্ষ ভালোবাসাকে তবে বুকে করে বেড়ানো যায় কি করে? বারবার তার কাছে নিজের অসহায়তা বুঝিয়ে? তাকে বারবার নানান ভাবে উত্তক্ত করে, ঘ্যানঘ্যান করে আদায় করেই ছাড়ব ভেবে? অথবা অন্য কোনো কৌশলে বা চক্রান্তে?
এর কোনোটাই নয়। বাচ্চা মেয়েটার উত্তরটা খুব আশ্চর্য লাগল – আমি তো তাকে কষ্ট দিইনি! তবে থাক, আপনি বলবেন না তাকে।
এত শুদ্ধ ভাবটা সে পেল কি করে? অথচ এর বিপরীতটাই তো দেখছি নির্লজ্জের মত নানান ভাষায়, বিকারে আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। অপরজনকে বিব্রত করে, অপদস্থ করে, উৎপীড়ন করে, তার সৌজন্যবোধের যথার্থ সুবিধা নিয়ে, আত্মদাবির ফরমায়েশ চলেই যাচ্ছে চলেই যাচ্ছে। কি ঘৃণ্য পরিণতি ঘটছে। তবে তাও সই, তাও চলুক, তাও পাই।
জেদ মানে ভালোবাসা না। মনোযোগ মানে ভালোবাসা না। আসলে কিছু মানেই ভালোবাসা না। কারণ ভালোবাসা মানে কিছু না। ওটা একটা দাবী না, ওটা একটা ব্রত। সে ব্রত উদযাপনের ভার আরেকজন না নিলে নিজেকেই নিতে হয়। আর যদি সেও সে ব্রত উদযাপনের ভার নেয় সে তো খুব ভালো কথা। কিন্তু না নিলেও সে ব্রত যেন অসম্পূর্ণ না থাকে। তাতে নিজের দীনতার প্রকাশ। অসম্পূর্ণ ব্রতের পাপের জন্ম দেয়। তাই ভালোবাসার সে ব্রতকে সার্থক করতেই হয়। নিজের জন্য। নিজেকে পরিপূর্ণ করার জন্য। আর সে সবই হোক গোপনে। একান্ত গোপনে। সে যেন জানতেও না পারে তাকে ভালোবেসেছিলাম। কারণ যে ভালোবাসা মনে করাতে হয়, সে আধসিদ্ধ চালের মত, না হয় পরিপাক, না হয় বমি। মাঝখান থেকে পেট ব্যাথায় প্রাণ যায়। তখন ভালোবাসা পিট্যুইটারীর কার্য ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। মস্তিষ্কের আরো গভীরের মননের আলো সেখানে পৌঁছায় না। যদিও অজ্ঞতার অন্ধকারে চলার স্বাধীনতা সবার আছে। চিরটাকাল থাকে। তবে সে একটা অন্ধকার থেকে আরেকটা অন্ধকারেই নিয়ে যায় মাত্র। এর বেশি কিছু সে পারে না। একটা কবিতা মনে পড়ছে... তাই দিয়েই শেষ করি –
সত্য যা দিয়েছিলে থাক্ মোর তাই,
দিবে লাজ তার বেশি দিলে।
দুঃখ বাঁচাতে যদি কোনোমতে চাই
দুঃখের মূল্য না মিলে।
দুর্বল ম্লান করে নিজ অধিকার
বরমাল্যের অপমানে।
যে পারে সহজে নিতে যোগ্য সে তার,
চেয়ে নিতে সে কভু না জানে।
প্রেমেরে বাড়াতে গিয়ে মিশাব না ফাঁকি,
সীমারে মানিয়া তার মর্যাদা রাখি,
যা পেয়েছি সেই মোর অক্ষয় ধন,
যা পাই নি বড়ো সেই নয়।
(দায়মোচন, রবীন্দ্রনাথ)
দিবে লাজ তার বেশি দিলে।
দুঃখ বাঁচাতে যদি কোনোমতে চাই
দুঃখের মূল্য না মিলে।
দুর্বল ম্লান করে নিজ অধিকার
বরমাল্যের অপমানে।
যে পারে সহজে নিতে যোগ্য সে তার,
চেয়ে নিতে সে কভু না জানে।
প্রেমেরে বাড়াতে গিয়ে মিশাব না ফাঁকি,
সীমারে মানিয়া তার মর্যাদা রাখি,
যা পেয়েছি সেই মোর অক্ষয় ধন,
যা পাই নি বড়ো সেই নয়।
(দায়মোচন, রবীন্দ্রনাথ)