একটা কয়েন পড়ল মাটিতে। আমার কানে শব্দ আসল। মনে চমক দিল, আমি ফিরে তাকালাম।
একটা গভীর শোক পেলাম। মন তার সাজানো, গোছানো ধ্যান-ধারণায় আঘাত পেল। আমার বোধ আরো গভীর হল। জলের উপরের স্তরের ঢেউ ছেড়ে আমি মাটির সন্ধানে ডুব দিলাম। আমার বিশ্বাস - এ সমস্ত চলমান, ঘটমান, পরিবর্তনশীল সব কিছুর পিছনে কিছু একটা আছে যা স্থির, যা অপরিবর্তনশীল। তা না হলে, এত পরিবর্তনের মূলসুরটুকু কে বেঁধে রাখছে, তাল তো কাটছে না।
এই কয়েন, এই শোক, এরাই হলেন গুরু - যিনি অন্ধকার দূর করেন। অজ্ঞানতার অন্ধকার, জড়তার অন্ধকার। যা কিছু আমার চেতনাকে নাড়া দেয়, ধাক্কা দেয়, ভাবিয়ে তোলে - তাই আমার গুরু। গুরু শব্দটা পুরোনো হলেও তার অর্থটা পুরোনো হয় না কোনোদিন।
যদি খেয়াল করি, এই জাগিয়ে দেওয়ার ঘটনাটাকেই যদি মূল লাভ বলে মনে করি, তবে শোকের, ক্ষতিরও একট অর্থ পাই। আমার সাথে কেউ একজন বিশ্বাসঘাতকতা করল। আমি গভীর যন্ত্রণা পেলাম। খুব সত্যি কথা। কিন্তু একটু শান্ত হয়ে ভাবলে দেখি, আমি জাগলামও তো বটে। একটা গভীর নাড়া আমায় আরেকটা সত্যির সাথে পরিচয় তো করালো। আমি জেগে যা দেখি, তা সত্য। ঘুমিয়ে যা দেখি, তা স্বপ্ন। যা সত্য, তাকে স্বীকার করার চেয়ে, মনুষ্যত্বের মহত্ব তো আর কোথাও অনুভব করার জায়গা দেখি না।
সারাদিন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র থেকে বিনা মেঘে বাজ পড়ার মত চমক প্রতিদিনই পাই। তার থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে, মুখ ফিরিয়ে থাকলে ঘুমটা দীর্ঘ হয় সত্য, কিন্তু জেগে ওঠার আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করি। ঘুমের সুখের সাথে দুঃস্বপ্নের ভয় আছে, কিন্তু জেগে ওঠার আনন্দের সে ভয় নেই। কারণ আনন্দ আর ভয়ের সাপে নেউলে সম্পর্ক। ভয়কে জয় করেই আনন্দের প্রকাশ। তাকে এড়িয়ে গিয়ে নয়। তাই আমাদের শাস্ত্রে 'অভীঃ' বা ভয়হীনতার কথা ঘোষিত হয়েছে। তা দুঃসাহসে ভর করে না, কারণ দুঃসাহসিকতারও একটা গৌরব অর্জনের লোভ আছে, আনন্দের সে বালাই নাই।
প্রতিদিনের আমার চেতনাকে এভাবে জাগিয়ে তোলার মুহুর্মুহু আয়োজনে আমি মুগ্ধ। এ জগৎ থেকে কিছু নেওয়ার জন্য না, জাগবার জন্য এসেছিলাম। বীজ যেমন মাটি ফুঁড়ে নীলাকাশে মাথা তুলে দাঁড়ায়, সে কি পাওয়ার জন্য? না, নিজেকে প্রকাশ করার জন্য। আমার জীবনটাও তাই। তার একদিকে ভরে ওঠে, আরেকদিকে হারিয়ে যায়। কিন্তু এই ভরা - হারানোর খেলার মধ্যে সে 'হয়ে ওঠে'। নিজের মধ্যে নিজেকে আবিস্কার করে। সেই আবিস্কারের কিছু অভিজ্ঞতা গানে, কবিতায়, ছবিতে রেখে যাওয়ার চেষ্টা করে। তা যেন দীর্ঘ পথের ধারে ধারে অগ্রগতির পথচিহ্ন। আমার চেতনার অভিব্যক্তির সুর। এ আমার মানুষ হয়ে জন্মানোর দায় - গুরুকে স্বীকার করে, তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে নয়।