সৌরভ ভট্টাচার্য
14 April 2019
আমাদের ক্ষুদ্র আশা, ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। যা কিছু বড়, মহৎ তাকে আমরা সন্দেহের চোখে দেখে এসেছি। আমাদের খুচরো চালাকি, খুচরো ত্যাগ, খুচরো কর্তব্যবোধ। আর এইসবের মধ্যে দাঁড়িয়ে একটা বিশাল পর্বত প্রমাণ – আমি আর আমার অভিমান।
আমি না-অভিমানী বাঙালি দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সকালে কলে জল না এলে অভিমান, মাছের বাজারে মনের মত মাছ না পেলে অভিমান, নিজের প্রিয় নেতার বিরুদ্ধে কেউ কোনো কটূক্তি করলে অভিমান, প্রিয় নায়কের সিনেমা মনের মত না হলে অভিমান। এ তো গেল বাহ্যিক। নিজেকে নিয়ে অভিমানের তো শেষ নেই আমাদের। আমার রূপ, আমার চাকরি, আমার বাড়ি, আমার গাড়ি, আমার ভবিষ্যৎ, আমার বর্তমান সামাজিক অবস্থান – কিছু আমাদের মনের মত নয়। আজকাল আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইক না পড়লে অভিমান। এখন তারও বাড়া, লাইক কেন? লাভ সাইন নয় কেন? আমি তো ওর ওখানে কমেন্টস করেছি, ও কেন করে না, তার অভিমান। ইত্যাদি ইত্যাদি।
আসলে আমরা বরাবরই অল্পে তুষ্ট। ছেলেমেয়ের একটা যা হোক সরকারি চাকরি, একটা বাড়ি, সুগার – প্রেসার – ল্যারেঞ্জাইটিস – গ্যাস – অম্বল - স্পন্ডাইলোসিস সম্বলিত দেহটার একটু আরাম, মোটামুটি একটা ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, একজন গুরুর কাছে দীক্ষা, কয়েকটা নির্দিষ্ট গান, সিনেমার পরিমণ্ডল, আর প্রাণ খুলে সুক্ষ্মতর্কে পাড়া প্রতিবেশী থেকে পার্লামেন্ট হয়ে মায় মার্কিন দেশের অবস্থা নিয়ে একটু পরনিন্দা-পরচর্চা করার মত একটা শুদ্ধ বিবেক – ব্যস, আর কি চাই?
আর কিছু চাই না। আমরা দুর্বল জাত। আমাদের সন্দেহ, চাতুরী আর কপটতাও বড় একটা উচ্চমানের নয়। সারাদিনের জীবনযাত্রায় কাউকে একটু ভাড়াটা কম দিলে, দরদামে অন্তত একটা টাকা কমালে, কাউকে নিজের বাক প্রতিভায় একটু নিরস্ত বা মুগ্ধ করতে পারলেই আমার সারাটাদিন মেঘলা আকাশ...থুড়ি সারাটা দিন আনন্দে কেটে যায়। আমি কোলবালিশটা জড়িয়ে একটা ‘রুচিকর’ গান চালিয়ে বেশ আবেশে চোখবুজে কত কি ভেবে নিতে পারি। নিজেকে যে জায়গায় দেখতে চেয়েছিলাম, হল কই? ভাগ্যের প্রতি অভিমান, রামকৃষ্ণ-কালী-মহাদেব-লোকনাথ-রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি কোনো ভগবানের ওপর অভিমানে ঠোঁট ফুলে আসে, গলাটা বুজে আসে... তখন একমাত্র সম্বল আমাদের চিনি ছাড়া লিকার চা। আমাদের সব অভিমান ধুয়ে যায়। আমরা নতুন কোনো জায়গায় বা আগে ঘোরা কোনো বেড়াতে যাওয়ার জায়গার হদিস খুঁজি, ছুটির তালিকা দেখি, ট্রেনের সিট অ্যাভেলেবেলিটি দেখি... উত্তেজিত হই, সুখী হই।
মিথ্যা আমাদের মাথার মুকুট। আমার বুদ্ধিমত্তার সব চাইতে সুক্ষ্ম জ্যোতি। তাকে নিন্দা কোরো না। মন মুখ এক সন্ন্যাসীই করেনি তা আমরা! আমাদের খবরের কাগজ সত্যি কথা ছাপে না, শিক্ষক সত্যি কথা বলে না, চিকিৎসক মারের ভয়ে গা বাঁচিয়ে চলে সত্যিটা বলতে পারে না, পাড়া প্রতিবেশী সত্যি কথা বলে না, বন্ধু বান্ধব সত্যি কথা বলে না, আমি নিজেও নিজের কাছে সত্যি কথা বলি না। তবে আমাদের দু’রকমের মিথ্যা আছে। এক সত্যি সত্যি মিথ্যা। আর মিথ্যা মিথ্যা সত্যি। সত্যি সত্যি মিথ্যা মানে যেগুলোকে আমরা ঢপ, গুল, ডাহা মিথ্যা কথা বলে থাকি। আর মিথ্যা মিথ্যা সত্যি মানে, আমরা যেগুলোকে বাস্তব প্রমাণের বিরুদ্ধে গিয়েও প্রাণপণ লড়ে সত্যি বলে বিশ্বাস করি। যেমন বাঙালির চাইতে শ্রেষ্ঠ সাহিত্য, সঙ্গীত, বুদ্ধি প্রতিভা উড়ে – বিহারী – তামিল - তেলেগু ইত্যাদির হয় না। আমাদের সাথে একাসনে বসতে যদি কেউ পারে সে একমাত্র ফরাসী, জার্মান আর কিছুটা ইংরেজরা ইত্যাদি ইত্যাদি। এরকম আরো নানা মিথ্যা মিথ্যা সত্য আমাদের ভাঁড়ার ঘরে শিকড়বাকড় বিছিয়ে বসে আছে। একটাকে টান দিলেই হুড়হুড় করে বাকিগুলো বেরিয়ে আসবে। আর নিজেকে নিয়ে মিথ্যা? বাঙ্গালী আজন্ম মহাপুরুষ, কালের ঘোরে, পরিস্থিতির চাপে দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থায় থাকে।
তবে এখন, এই মরশুমে বাঙালি খুব সজাগ। এখন আমাদের নিন্দা-লক্ষ্য বাছার সময়। অর্থাৎ আগামী পাঁচ বছর কাদের নিশ্চিন্তে বুক বাজিয়ে নিন্দা করতে পারব তাকে বাছার সময়। আর এ নিন্দা করতে তো শুদ্ধ বিবেক আমাদের আছেই। কারণ যা কিছু ভালো তা হয় অতীতে ঘটে গেছে অথবা তা আমাদের মাটিতে আসতে দেরি আছে – তাই যা কিছুই হচ্ছে খারাপ হচ্ছে এ নিয়ে তো সন্দেহই নেই। আর তারাও হয়েছে তেমন। তারাও জানে এরা আমাদের সব কিছুতেই নিন্দা করবে, অগত্যা আমরাও চালিয়ে যাই, তোমরাও চালিয়ে যাও। মিথ্যার একটা মস্ত সুবিধাই তো হল যেমন খুশী সাজিয়ে নেওয়া যায়। আর আমরা যখন বস্তুর গুণের থেকে সাজের দিকে বেশী টান অনুভব করি তখন আমাদের ঠকাতে তো কারোর কোনো অসুবিধা নেই। আর আমরাও তো একে তাকে ঠকিয়ে, মানে খুচরো ঠকিয়ে, কর্তব্যে ফাঁকি দিয়ে জীবন ধারণের চেষ্টায় আছি, নাকি? তবে? একটা কথা তো সবাই জানি, আমরা সবাই নিজেকে বঞ্চিত ভাবি। এতে আমাদের একটা মস্ত সুখ। পরনিন্দাতে আমাদের মস্ত সুখ, যদিও আমরা ওগুলোকে বাধ্যতামূলক সমালোচনা বলেই মানি। নিন্দুকে যা রটায় সে অন্য কথা। আমরা সবাই বিশ্বাস করি আমরা কেউ ভালো নেই। কিন্তু এই ভালো না থাকার মধ্যে আমরা বেশ একটা সুখে আছি। কারণ আমাদের সব ভালো না থাকার কারণগুলো সব ওদের বানানো। ওদের মানে কাদের? সে তুমি শূন্যস্থান পূরণ করে নাও, আমি ব্ল্যাংক চেক দিলুম।