শান্তির আকাঙ্খা দুর্বল করতে পারে। প্রেমের আকাঙ্খা বিকারগ্রস্ত করতে পারে। রুদ্র প্রেমকে সবল করে। শান্তিকে বলিষ্ঠ করে।
রবীন্দ্রনাথের দর্শনে রুদ্রের আহ্বান আছে। রুদ্র যা কিছু দুর্বল, মোহগ্রস্ত, আসক্ত.... তাকে ভেঙে তছনছ করে দেয়। রুদ্রের প্রকাশ ত্যাগে, বৈরাগ্যে। "বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়" যিনি লিখছেন, তিনিই "বৈরাগ্য" বলে প্রবন্ধটা লিখছেন "শান্তিনিকেতন" গ্রন্থে।
যা কিছু দুর্বলতা আনে, সে পাপ। যা কিছু সংকীর্ণতা আনে, সে পাপ। রুদ্রের তেজ তাকে পুড়িয়ে শুদ্ধ করে। সবাইকে জীবনে কোনো না কোনো এক সময় রুদ্রের সে তেজকে সহ্য করতে হয়। করতেই হয়। রুদ্রের সাধন থেকে পালালে নিজেকে দুর্বল, বিকারগ্রস্ত করে জীবনটাকে অন্ধকারে নিয়ে গিয়ে ফেলতে হয়।
আজ বাইশে শ্রাবণ। রবীন্দ্রনাথের কথা বিশেষ আবেগে মনে আসবে, সে স্বাভাবিক। কিন্তু সে শুধু লঘু অগভীর আবেগের কয়েকটা গান-কবিতায় না। সে দুর্বলতা। বারবার মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাঁদুনে, আবেগসর্বস্ব, নিজেকে নিজের হাজার একটা দুর্বলতার দাস করে, রজনীগন্ধার মালা জড়িয়ে দুর্বলতার শীতল মর্গে বাঁচতে বলেননি। সব দুর্বলতা রুদ্রের তেজে ছিন্নভিন্ন করে বাঁচার রাস্তা দেখিয়েছিলেন। শুধু রবীন্দ্রনাথের কাজ তার সাক্ষ্য বহন করে না, তাঁর জীবনও।
ঈশ্বর রবীন্দ্রনাথের কাছে শুধু সুখ নন। নাচগানের উন্মাদ আবেগ নয়। শান্তিনিকেতন বইতে “ভাবুকতা ও পবিত্রতা” প্রবন্ধে লিখছেন স্পষ্ট করে ভাবুকরা কীভাবে একটা চরিত্রকে নষ্ট করে দেয়।
সুখ নয়, প্রেম নয়, শান্তি নয় - সবার আগে দরকার একটা পাত্র। বলিষ্ঠ পাত্র। যা এ সবকে কলুষিত করবে না।
বলিষ্ঠ চরিত্র একমাত্র সম্ভব রুদ্রের আদেশের কঠোরতা সহ্য করে। যখন যা ত্যাগ করতে হবে, করতেই হবে। যখন যা সহ্য করতে হবে, করতেই হবে। আর এ সবই করতে হবে সত্যের কঠোর আদর্শের পায়ে আত্ম-আহূতি দিয়ে। “আত্মহোমের বহ্নি জ্বালা”।
দুর্বলতা আছে। ঈর্ষা, ক্রোধ, ক্ষোভ, ভয় সব আছে। সবার মূলে আছে মোহ। বৃহৎকে ক্ষুদ্র করে দেখার ভ্রম। সত্যকে মিথ্যার পিলসুজে জ্বালার স্পর্ধা। চাতুরীকে প্রজ্ঞার বিকল্প মনে করার ভুল। যেখানে কঠোরতা নেই, যেখানে আত্মত্যাগ নেই, যেখানে নিজের বিরুদ্ধে নিজের লড়াই নেই, সেখানে সবটাই অন্তঃসারশূন্য শূন্যকূম্ভের আওয়াজ। ওর কোনো অর্থ নেই, দিশা নেই।
রবীন্দ্রনাথের উপাস্য রুদ্রকে স্বীকার করলে জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিসের উপর দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়। বুকের খাঁচায় আরো বেশি করে অক্সিজেন আসে। দৃষ্টি আরো স্বচ্ছ হয়। জীবনের কঠোরতাকে এড়িয়ে, জীবনকে ব্যর্থ করার হাত থেকে নিজেকে রক্ষার দায়িত্ব আমারই। জীবন একটা চয়েস। তা গন্তব্যের উপর ততটা নির্ভর করে না যতটা নির্ভর করে যাত্রাপথটার উপর। কোন রাস্তায় হেঁটেছিলাম। দুর্বলতা, না কঠোরতার? শ্রেয়, না প্রেয়ের রাস্তায়।
আজ বাইশে শ্রাবণ বিশেষভাবে বাঙালির কাছে বাইশে শ্রাবণ। আজ আবার শ্রেয়কে প্রতিষ্ঠা করার দিন। অনেকদিন ঘুমিয়েছি আমরা। জেগে উঠলে বোঝা যায় জীবনটা সুখের অন্বেষায় বাঁচার না, জীবনটা কঠোরতায় আত্মত্যাগের। সত্যের জন্য। ধর্মের জন্য। ধর্ম কী? যে উত্তর রবীন্দ্রনাথ গান্ধারীর মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন। যখন দুর্যোধনকে ত্যাগ করার উপদেশে দিয়েছলেন ধৃতরাষ্ট্রকে। বলেছিলেন দুর্যোধনকে ত্যাগ করলেই রক্ষা পাবে ধর্ম। যা সুখ দেবে না। দেবে “দুঃখ নব নব”। রুদ্র কোনো দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেয় না, এমনকি ঔদ্ধত্যকেও নয়। তাই সে রুদ্র।
আজ রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে স্মরণ করার দিন। বিশেষ করে প্রণাম করার দিন।