Skip to main content

আত্মহত্যার খবর আচমকা পাওয়া যায়। কিন্তু আত্মহত্যার প্রস্তুতি?

কারণ তো অনেক জানা যায়। পরে। আর্থিক অনটন। অবসাদ। পারিবারিক অশান্তি। ব্যর্থতা। আরো আরো নিশ্চয়ই অনেক আছে।

একজন মানুষ হঠাৎ করে আর বাঁচতে চায় না। হতে পারে একটা প্রতিবাদ করে যায় এইভাবে। হতে পারে অভিমানকে জানিয়ে দিয়ে যায়। কিন্তু যে মানুষ জানে সে চলে গেলে কারোর কোথাও কোনো আঘাত লাগবে না, সে হয় তো আত্মহত্যা করতে চায় না। আত্মহত্যা করতে গেলেও হয় তো মনুষ্যত্বের উপর একটু বিশ্বাস থাকা চাই। নইলে কিভাবে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবে সে? সে কোথাও একটা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করে তার চলে যাওয়াতে সমাজের বিবেকে কোথাও হয় তো আঘাত লাগবে? পরিবার পরিজন কোথাও হয় তো বুঝবে সে সত্যিই সমস্যায় ছিল। আগে বারবার ইঙ্গিত দিলেও যেটা কেউ বুঝছিল না। যদি না সে আত্মহত্যা করে শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে।

অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। কেউ শারীরিক রোগের জন্য। কেউ অবসাদে।

কারণ যাই হোক, একজন মানুষ কেন নিজেকে সরিয়ে নিতে চায়? নিজের ক্ষমতা, সমাজের সহমর্মিতা সব কিছুর উপর বিশ্বাস চলে গেলেই তো। এমনকি ঈশ্বরেও। তার যখন মনে হয়, আদতে ঈশ্বর বলে কেউ একজন থাকলেও তিনি তার সুখ-দুঃখ নিয়ে আদৌ ভাবিত নন। তখনই কি?

নিজের ক্ষমতা নেই। কারোর সাহায্য নেওয়ার রুচি নেই। কোনোদিকে কোনো আশা নেই। সে মানুষটা কোথায় যাবে?

তার চাইতে কি ঘ্যানঘ্যানে মানুষ ভালো? তার চাইতে কি সে ভালো যে বারবার নিজের অক্ষমতার জন্য হাত পাতে? মনের কষ্ট, অশান্তি শুনতে না চাইলেও রাতদিন প্যানপ্যান করে বলতেই থাকে? বুকের মধ্যে অভিমান জমিয়ে রাখা কি ভালো? নাকি সব অভিমান জলাঞ্জলি দিয়ে সাহায্য চাওয়াই ভালো?

যদি আর্থিক অনটন, জীবনে অস্বাচ্ছন্দ্য আত্মহত্যার কারণ হত তবে দেশে গরীবী হটাও স্লোগানের দরকার হত না। সব আপনিই হটে যেত। দেশের জনসংখ্যা নিয়েও ভাবতে হত না। গণ আত্মহত্যা হত। মন্দিরের বাইরে যে মানুষেরা হাত পেতে বসে থাকে তাদের চাইতে বড় বস্তুবাদী, নাস্তিক কে আছে? তার জন্য অক্সফোর্ড, হাভার্ডে গিয়ে দর্শন ইত্যাদি পড়ার দরকার হয়নি তাদের। তারা জানে হাত কোথায় পাততে হবে। মন্দিরের দরজায় মানুষ এসেছে মানেই সে দুর্বল হয়েছে কোনো না কোনো ভাবে। কিছু না কিছু দেবেই। সব মানুষের মধ্যেই অন্তঃশীলা অপরাধবোধের স্রোত থাকে। গণচেতনা মানেই তো অন্তঃশীলা অপরাধবোধ। নইলে এত সহজে অন্যকে বঞ্চিত, বুভুক্ষু জেনেও নিজেকে এত আরামে রাখা যায়? ভিখারি এ মনস্তত্ত্ব জানে। আর জানে বলেই মন্দিরের সামনে ওইভাবে অন্তঃশীলা অপরাধের স্রোতকে আঘাত করে। ভিতরে ভিতরে সবাই কমবেশি ঝলসে উঠি। হয় খুব জোর করে এড়িয়ে যাই। নইলে কম্প্রোমাইজ করে কিছু পয়সা দিয়ে নিজেকে রক্ষা করি।

ভিখারি এ মনস্তত্ত্ব জানে বলেই শপিংমলের বাইরে, মাল্টিপ্লেক্সের বাইরে ভিড় জমায় না। একজন দুজন থাকতে পারে। কিন্তু লাইন ধরে বসে থাকে না। কারণ ওখানে অন্তঃশীলা নিজেকে গুটিয়ে রাখে। ওটা মোটা দাগের অহংকারের চরে খাওয়ার জায়গা। ভিখারিকে এ মনস্তত্ত্ব বুঝতে ফ্রয়েড, ইয়ুং পড়তে হয় না। প্রকৃতিই সব শিখিয়ে দেয়। প্রাণে প্রাণে এ সত্য অনুভব হয়।

সমাজে এক ধরণের শিক্ষা পেতে পেতে জগতের বাস্তুতন্ত্রটা ভুলে যেতে হয় আসলে। সবাই আজন্ম শেখাচ্ছে আত্মনির্ভরশীল হও, নিজের পায়ে দাঁড়াও, নিজেকে নিয়ে নিজে গর্বিত হও ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই সব কথা গাঁঠরিতে বেঁধে যাত্রা শুরু তো হল। দেখা গেল দিন যত যেতে লাগল গাঁঠরির বাঁধন আলগা হতে শুরু করল। এক একটা বিপর্যয় এক্কেবারে পঙ্গু করে দিতে শুরু করল। সবাইকে নয়, কাউকে কাউকে। ভাগ্য এমন বিরূপ হল সোনাতে হাত দিলে সে লোহা হয়ে যায়। নিজের নানা অক্ষমতা জন্মাতে শুরু করল। মানসিক, শারীরিক, আর্থিক, পারিবারিক। জর্জরিত অবস্থা। কোনোভাবে ঠেকানো যাচ্ছে না। শুধু সাক্ষী থেকে যেতে হচ্ছে। এদিকে নিজের মান, নিজের অহংকার ডানায় পালকের এই দুর্দশা দেখে এত অস্থির হয়ে উঠছে যে নিজেকে স্থির রেখে ভাবাও দায়। সে খালি বলছে আমাকে যেভাবে হোক ওড়ার ব্যবস্থা করে দাও। আমি কি অমুক তমুকের মত হব শেষে? আমি কি ভিখারি হব শেষে?

তখন সে যায় তো যায় কোথায়? আশাবাদী, নিরাশাবাদী সব অর্থহীন। ঈশ্বর, ধর্ম, জ্যোতিষী ইত্যাদি গুপ্ত সাহায্যকারীরাও মরীচিকা হয়ে মিলিয়ে গেছে তদ্দিনে। এই প্রচণ্ড দেউলিয়াপনা, এই অসম্ভব অভিমান… এ নিয়ে কি করে সে? মরে। নিজেকে শেষ করে দেয়। ওই যে বললাম বাস্তুতন্ত্র। এইভাবেই ভিখারিকে ঘেন্না করার, পঙ্গুকে করুণা করার, সমাজের শেষ ধাপে বসে থাকা মানুষটাকে আন্তরিকভাবে সম্মান না করতে পারার কুশিক্ষার পরিণামে সে পৌঁছায়।

আসলেই এ খুব শক্ত। জগতে সব শিক্ষা, ধারণা, অভ্যাস একদিকে আর জগতরূপী বাস্তব জগতটা অন্যদিকে। যে কোনো সময়ে যে কোনো পরিণতির জন্য তৈরি না থাকলে সে ছেড়ে দেবে না তো। আইনসম্মত আত্মহত্যাই হোক, আর আইনবিরুদ্ধ। আদতে হেরে যাওয়াকে মেনে নিয়ে রাস্তায় এসে বসার সত্যকে স্বীকার করে নেওয়া কি এত সোজা? একদম নয়। তার চাইতে বিষ খাওয়া, গলায় দড়ি দেওয়া, রেললাইনে শোয়া অনেক সোজা। অভিমানে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া অনেক সোজা।

এই রূঢ়, তেতো বাস্তবের শিক্ষাটা কোনো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কোনো শৌখিন ধর্ম কেউ দেয় না। এ শিক্ষাটা চিরকাল দিয়ে এসেছে কিছু মানুষ। যাদের প্রাণে প্রাণে অনুভব হয়েছে, জগতে যে কোনো সময়ে যা কিছু হতে পারে, সে এমন কিছু মূল্যবান নয় যে নিজের মান-অপমান, অবস্থা ইত্যাদিকে নিয়ে এত মাথা ঘামাতে হবে। বরং জীবনটাকে জীবনের মত দেখা যেতে পারে। যতক্ষণ না মরণ আপনিই এসে প্রদীপটা নিভিয়ে দিয়ে যায়। ক্ষোভ, অভিমান, অশান্তি, জ্বালাপোড়া সব থাকবে। কোনো যোগ্যতা না থাকাটাও যোগ্যতা। আসলে যোগ্যতার প্রশ্নটাই ভীষণ মেকি। অহং মানুষী। বাস্তবিক নয়। সব নিয়েই থাকতে হবে। না থাকলেও ক্ষতি নেই। তবে থাকাটাও যেতে পারে। চয়েস আমার। এ নিয়ে তর্ক চলে না। ঈশ্বরের অস্তিত্বের মত। জগত তার নিজের নিয়মে চলে। তাল রাখতে পারলে থাকো। নইলে যাও। চয়েস তোমার, আমার।