Skip to main content
 
 
        আমাদের চেতনায় একটা মধ্যযুগীয় শেওলা বরাবরই আছে। আজ বলে নয়। মধ্যযুগীয় নানা ধ্যান-ধারণারা এখনও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যথেষ্ট প্রভাব রাখে। আমাদের চেতনায় একটা পচন ধরেছে। যে পচনটার আশু সমাধান না খুঁজলে সত্যিই বিপদ। প্রগতিশীল, মুক্তমনা ইত্যাদি কথার অর্থ আমি ততটা বুঝি না, যতটা বিজ্ঞান নির্ভরতা বুঝি।
 
        মধ্যযুগীয় শেওলা বলতে কি বুঝি সেটা আগে স্পষ্ট করে নিই। আমাদের ধর্ম আর সমাজব্যবস্থা একে অপরের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে জড়িয়ে। তাদের মূল ব্যাখ্যা প্রাচীন অথবা মধ্যযুগীয় নানা বিধানের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। তার মধ্যে মিশ্রণ ঘটেছে বহু পরের দিকে। মূলত আমাদের ধর্মের যেদিকটা দর্শন, যেদিকটা অতীন্দ্রিয় সেদিকটা ততটা হানিকারক নয় যতটা আমাদের আচার-বিচার সম্পর্কিত বিধানগুলো। কিন্তু আমরা প্রত্যেকটাকে একে অপরের সাথে জড়িয়ে দেখি। কারণ সুক্ষ্ম বিশ্লেষণের মাধ্যমে একে অপরটার থেকে পৃথক করে দেখা সাধারণের পক্ষে সম্ভব না। আর পচনের সূত্রপাত সেখান থেকেই। আচার-বিচার আর পরলৌকিক জীবনের প্রতি অগাধ আস্থা আমাদের জনজীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মুষ্টিমেয় কয়েকজন মুক্তচিন্তকের কাজ নয় এর স্রোত অন্যদিকে ঘোরানো। মজার কথা হচ্ছে আমাদের জনজীবনের এই স্রোতের মুখ যারা ঘুরিয়েছিলেন তারাও আরেকটা কোনো ধর্ম্মমতের সূচনা করেই আগেরটা থেকে আমাদের বাঁচাতে চেষ্টা করেছেন। ফলে আমাদের যে ক'টা সামাজিক বিপ্লব হয়েছে সেগুলো প্রকারান্তরে ধর্মবিপ্লব। ফলে যে কোনো আন্দোলনের পুরোধা হয়ে থেকেছে আমাদের ধর্মানুগত্য। রামমোহন, গান্ধীজী, নেতাজী, রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি সমাজসংস্কারকেরা তো বটেই, স্বামীজি-দয়ানন্দ সরস্বতী ইত্যাদিরা তো আছেনই। এই ধারার একমাত্র ব্যতিক্রমী ছিলেন বিদ্যাসাগর মহাশয় উত্তর ভারতে আর দক্ষিণে ই ভি রামস্বামী পারিয়ার। যদিও রামস্বামীর মধ্যে একটা পাশ্চাত্যের কম্যুনিজমের প্রভাব ছিল। কম্যুনিজম আরেক প্রকার ধর্মানুগত্যের কথা বলে।
        আধুনিক পথের ভারতের প্রথম পুরুষ আমার মনে হয়ে বিদ্যাসাগর যিনি সম্পূর্ণ নিজের বিবেকজাত শক্তিতে দাঁড়াতে পেরেছিলেন। স্বীয় বুদ্ধি-বিবেকের বাস্তবায়িত রূপ আনার জন্য কোনো ঈশ্বর তথা গুরু তথা অবতার তথা শাস্ত্রানুগত্য দেখাননি। মনে রাখতে হবে যে সেই সময় অমন রামকৃষ্ণের আন্দোলনের থেকেও নিজেকে মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন। রামকৃষ্ণ নিজে ওনার সাথে দেখা করতে যান, দু'জনের কথাও হয়, রামকৃষ্ণ চেয়েছিলেন বিদ্যাসাগর তার সাথে যোগাযোগ রাখুন, কারণ তিনি রামকৃষ্ণের দৃষ্টিভঙ্গীতে 'নিজের ভিতরের সম্পদের খপর পাননি, তাই ওই সব লোকশিক্ষা, জনসেবা ইত্যাদি নিয়ে আছেন'। রামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগরের এই তাকে এড়িয়ে চলাটাও পরবর্তীকালে ভালো চোখে দেখেননি, বলেছেন, বিদ্যাসাগরের এত গুণ কিন্তু মিছে কথা কয়, কারণ আসব বলেও এলোনি।
        এই কথাটা ভাববার। যে মানুষটা নিজেকে এমন একজন শক্তিশালী ধর্মগুরুর কাছ থেকেও নিজেকে দূরে সরিয়ে সমাজসংস্কারের কাজে ব্রতী থাকলেন তার কি মূল্যায়ণ ভারতবর্ষ করল? না ভুল ভাবছেন, আজ ওনার জন্মদিন কি মৃত্যুদিন কিছুই নয়। যদিও আমাদের প্রথা ওই দুটো দিনেই অগভীর স্মরণ করে বাকিদিন ভুলে থাকা। আমাকে আজকের দিনে ওনাকে স্মরণ করালো আজকের ভারতের পরিস্থিতি। আজ ভারতের প্রধান সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায় বিবেকানন্দের জায়গায় যদি বিদ্যাসাগরের রোল মডেল থাকত আমার বিশ্বাস ভারত আরো এগোতো। বিবেকানন্দের পাশ্চাত্যাভিযান ছিল। সন্ন্যাসের আকর্ষণ ছিল। আধ্যাত্মবাদের আকর্ষণ ছিল। বিদ্যাসাগরের এর কোনোটাই ছিল না। তাঁর প্রধান সম্বল ছিল একটা সংস্কারমুক্ত মন আর অগাধ পড়াশোনা। এর কোনোটাই ভারতের চিত্তে আলোড়ন তোলার জন্য যথেষ্ট ছিল না। আমাদের ওতে কিছু যায় আসে না। আমাদের প্রয়োজন পরলৌকিক জীবনের একটা গতি। যদিও বিবেকানন্দ এই পথে আমাদের কয়েকবার নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু গায়ে গেরুয়া আর মঠের প্রতিষ্ঠাতার মুখে সে কথার আবেদন আর কতটা থাকে? আর রইল সেবা, বুঝতে অসুবিধা হল না যে ওটা খ্রীষ্টধর্মের সেবারই একটা পরিবর্তিত রূপ, ফলে সেও খুব একটা ধোপে টিকল না।
        বিদ্যাসাগরের সে দায় ছিল না। তার ফলে শেষ জীবনটায় যন্ত্রণারও শেষ রইল না। তাকে এই শিক্ষিত-ভদ্র সমাজ ছেড়ে দূরে কার্মাটারে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাতে হল আদিবাসী, অশিক্ষিত মানুষগুলোর সাথে। সেখানেই ভালো ছিলেন আমাদের এই মুখোশধারী সভ্য সমাজের থেকে।
        স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষে যে শেওলার কথা বলছিলাম তা দূর হওয়ার পরিবর্তে আরো স্থায়ী হয়ে বসল। এটা ভারতের একটা বৈশিষ্ট্য, কিম্বা অভিশাপ। আমরা আমাদের কোনোদিন দৈবমুক্ত ভাবতে পারি না। কেন পারি না জানি না, বোধ করি কেউ জানেন না। আর এখন তো বাতাসে একটা চল আছে যে আমাদের ধর্মে যা আছে তা পৃথিবীর কোনো ধর্মে নেই, এমনকি বিজ্ঞানের সব কথাগুলোও নাকি আমাদের বেদ-উপনিষদের সাথে মিলে যায়। কোন কথা কতটা টানলে কোন খাতে বয় সে বলা মুশকিল। কিন্তু যেটা হল তা হল একটা মোহ আমাদের কিছুতেই যাচ্ছে না যে আমাদের ধর্মের গল্পগুলোর বয়েস হয়েছে, তাকে আর ছোটানো যায় না। মানুষের যেমন ভীমরতি ধরে আমাদের ধর্মীয় সিদ্ধান্তগুলোরও তেমন ভীমরতি'র অবস্থা। আমাদের জ্ঞানের প্রয়োজন, প্রজ্ঞার প্রয়োজন কিন্তু কোনোমতেই আর যাগযজ্ঞ, জাতি-বর্ণের প্রয়োজন নেই। যিনি চূড়ান্ত বর্ণাশ্রম মানেন তিনিও ব্লাডব্যাঙ্কে গিয়ে তার মুমূর্ষু প্রিয়জনের জন্য আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের বিধানই মেনে নেন।
        এ আলোচনা দীর্ঘ করার প্রয়োজন দেখি না। ভারতে যদি সত্যিই কোনো মানুষ বৃহৎ অর্থে ধর্মহীন বিপ্লব ঘটিয়ে থাকেন সে বিদ্যাসাগর মহাশয় একা। আজ সে জীবনের শিক্ষা, বিশ্বাসের আলো প্রায় নিভু নিভু ভারতের চেতনা থেকে। যদি সত্যিই এ দেশটাকে জাগাতে হয়, যদি সত্যিই এ দেশের বিবেকের সামনে একটা বলিষ্ঠ আয়না তুলে ধরতে হয় তা অবশ্যই বিদ্যাসাগরের জীবন। সে তিনি আমাদের পরলৌকিক জীবনের ভার নিতে পারুন চাই না পারুন; বেদান্তের সুক্ষ্ম যুগোপযোগী ব্যাখ্যা করতে পারুন চাই না পারুন; তিনি আমাদের আত্মাকে সবল, সুস্থ করে তুলতে পারবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমাদের আজ গুরুর দরকার নেই, বিজ্ঞান আছে দর্শন আছে সে জায়গায়; আমাদের আজ সেবার জন্য কিছু আত্মার মুক্তলোভী গেরুয়াধারীর দরকার নেই, তার জন্য সেনা-তথা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা আছে; আমাদের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোও যতদূর সম্ভব ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত হোক তার জন্য বিচার-বিশ্লেষণ নির্ভর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। আর সর্বোপরি আমাদের সামনে যদি সত্যিই কোনো রোল মডেল দরকার তো তিনি বিদ্যাসাগর হোন। আমার মনে হয় আসিফা, নির্ভয়া, কামুদিনি ইত্যাদি কমবে। হাঁটার রাস্তায় কুয়াশা থাকলে বড় বিপদ। আবারও বলছি, ভারতে যে ধর্মবিশ্বাসমুক্ত একটা বড় নিঃশব্দ বিপ্লব তিনি সে যুগে ঘটিয়েছিলেন সেই আমাদের আদর্শ হোক। মানুষটাকে আমরা কার্মাটার থেকে আবার ফিরিয়ে আনি। নিজেদের দুর্ভাগ্যমুক্ত করি। ঈশ্বর বলে যদি কেউ থাকেন, তিনি আমাদের সেই সৎকাজেই প্রতিষ্ঠিত হবেন। সত্য কর্মে, ভেদাভেদি ধর্মে না।