No one to anyone - এই অনুভবটা কেমন? যার হয় সে জানে। সব আছে অথচ যেন কিছুই নেই। সবাই আছে, তবু যেন কেউ নেই। আমি দীর্ঘদিন এই অনুভবটার মধ্যে দিয়ে গেছি। মা চলে যাওয়ার পর। সবাই আছে, সব আছে, তবু কিছুই যেন নেই। কথাটা অবশ্য ঠিক মা চলে যাওয়ার পর নয়, আরো আগে থেকেই, যখন বুঝতে শুরু করলাম, মা আর থাকবেন না।
তারপর এক নিরবচ্ছিন্ন শূন্যতা। এদিকে সব কাজ তো করতে হবে। শুরু হল নিজের আবেগকে অস্বীকার করা। তাকে সামনে না আসতে দেওয়ার ছল। দায়িত্ব, কর্তব্য --- কোন কিছুই তো থেমে থাকবে না। কারোর জন্যেই দাঁড়ায় না। কিন্তু যত দিন যেতে লাগল, যত নিজের আবেগের থেকে নিজের দূরত্ব বাড়তে শুরু করল, তত ভিতরে ভিতরে শুষ্ক হয়ে যেতে শুরু করলাম। নকল অনুভব, নকল আবেগে আর কদ্দিন টেনে নিয়ে যাওয়া যায় নিজেকে। ভিতরে ভিতরে যেন মরে যাচ্ছি, শেষ হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এভাবে তো বেশিদিন নিজেকে চলতে দেওয়া যায় না। একটা কিছু তো করতে হবে। কি করতে হবে?
খুব কঠিন কাজটা - নিজের মুখোমুখি হতে হবে। নিজের আবেগের সমস্ত আঘাতকে সহ্য করতে হবে as it is. ভাষা বদলালে চলবে না, কোনো কপট বৌদ্ধিক ব্যাখ্যায় শর্টকাট খুঁজলে চলবে না, কোনোভাবেই ফাঁকি দেওয়া যাবে না। নিজের এই loss-কে নিজেকে স্বীকার করে নিতেই হবে। আবার হাঁটতেই হবে নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়ে। আধা-আধি আর নয়।
কিন্তু ভাগ্যে আরো কঠিন পরীক্ষা ছিল। করোনার দ্বিতীয় ওয়েভে ভাই চলে গেল। আবার মুখ থুবড়ে পড়লাম। কিন্তু এবার আর আগেরবারের ভুলটা করলাম না। এবার নিজের আবেগকে মাটি চাপা দিয়ে তার উপর নকল খুশীর মসনদ বানালাম না। একটা জিনিস এতদিন চলতে চলতে শিখে গিয়েছি যে মনের জোর বলে কিছু হয় না। মন অনেকটা আটা বা ময়দার লেচির মত। তার মধ্যে সত্যের পুর ভরলেই মন শক্ত হয়। সত্যকে মেনে নেওয়া ছাড়া মনের জোর বলে আলাদা কোনো কৌশল আমি জানিনি। অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের বহু চর্চিত কবিতা, ‘বোঝাপড়া’ আছে। কিন্তু বইয়ের পাতায় থাকা আর জীবনে থাকার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। সত্য যা, বাস্তব যা তাকে as it is স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। সে আমি নাস্তিক হই, কি আস্তিক হই। ওতে কিচ্ছু এসে যায় না। সত্যিকারের আস্তিকতার পরীক্ষাই হল, “তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হোক”। সত্যিকারের নাস্তিকতার পরীক্ষাই হল, “যা বাস্তব তাই মেনে নেব”। দুর্দিনে অনেক নাস্তিককে আস্তিক আর অনেক আস্তিককে নাস্তিক হতে দেখেছি। ও করে আদতে কোনো লাভ হয় না। কোনো দর্শনই স্বস্তি দেবে না, যদি সব দর্শনের মূল কথাটাকে অস্বীকার করি। সে মূল কথাটাই হল, যা আছে তাকে স্বীকার করে নেওয়া তার মত করেই।
শোক বাইরে কোথাও নেই। সে আমার মনে আছে। আমি বাইরে আর ভিতরে ছড়িয়ে আছি। আমার বাইরে যেমন অনেক দায়িত্ব, অনেক কর্তব্য আছে, তেমনই আমার নিজের আবেগ, অনুভবের উপরেও নিজের দায়িত্ব আছে। সংসারে আমার শোক সত্য নাও হতে পারে, কিন্তু আমার মনোজগতে তা বাস্তব। তাকে স্বীকার করে নেওয়ার সাধনা আমার। নিজের ভালোবাসার মানুষটার চলে যাওয়ার শূন্যতা কোনোদিন পূরণ হয় না। শুধু সেই শূন্যতাকে প্রতিদিন দেখতে দেখতে সয়ে যেতে শুরু করে। তার থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখলে জগৎ জোড়া শূন্যতার ভয় এসে গ্রাস করে নিজেকে।
তবে এই 'no one to anyone' অনুভবটা কেন? কারণ 'মা'। মা এমন একজন মানুষ, যিনি আমাদের চরম দুর্দিনেও ছেড়ে যাবেন না --- এমন আস্থা, আশ্বাসে আমরা বড় হই। বাকিরা চাইলে যেতেও পারে, এ আশঙ্কা আমাদের থাকে। এমনকি পরিণত বয়সেও ভালোবেসে কি সামাজিক তাগিদে ঘর বাঁধতেও আইনের দ্বারস্থ হতে হয় আমাদের। সেখানে বাঁধনের শর্ত থাকে। “আসা যাওয়া দুদিকেই খোলা রবে দ্বার” - এ দিয়ে কাব্য হয়, কিন্তু সংসার হয় না। সেই জন্যে অকালে মা চলে গেলে মনের মধ্যে এই অনিশ্চয়তার ঝড় ওঠা স্বাভাবিক। আর মনোবিজ্ঞান অনুযায়ী এ প্রমাণিতও। ‘আগন্তুক’ সিনেমায় যখন নাড়ির টান, কি রক্তের টানে একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ শুধুমাত্র পারিবারিক যোগসূত্রকে সম্বল করে আত্মীয়তার বাঁধনকে জাগিয়ে তুলতে আসছেন, অনেক সংশয়, অপমানের আশঙ্কা নিয়েই, তখনই এই একই কথা মনে হয়। মানুষ কোথাও নিজেকে সম্পর্কিত জানতে, সম্বন্ধিত অনুভব করতে ভালোবাসে। এমনকি গোটা বিশ্বের সঙ্গেও যে তার একটা সম্বন্ধ আছে, সেটাও সে ধর্মে, দর্শনে ঘোষণা করতে চায়। প্রাণপাত করতে চায় সে সত্যকে বাইরের জগতে রূপ দিতে।
তবু এ সব কথা থাক। মনের বিশ্লেষণ এক, আর ক্ষতবিক্ষত মনকে সজাগ, সচল করে নিয়ে সংসারের রাস্তায় নামা আরেক। সে জোর মনের মধ্যে থেকেই জন্মায় যদি নিজেকে সত্য স্বীকারের সাধনা থেকে দূরে সরিয়ে না রাখা যায়। এ কথা আগেই লিখলাম। কোনো বিশ্লেষণ, কোনো দর্শন, কোনো ধর্ম, কোনো মত তখন সাহায্য করে না। শূন্য দুপুরগুলো যেন গিলে খেতে আসত, সারা বাড়িটা যেন অপরিচিতের মত ঘিরে দাঁড়িয়ে আমায়। মন সারাদিন বলে চলেছে --- পালা, পালা। মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া বুক খামচে থাকা শোকের স্তূপ। কে সাহায্য করবে? পরেরদিন সকাল থেকেই তো আবার কর্তব্যের পালা। নিজের ভাগ্যের উপর রাগ। নিজের ভাগ্যের উপর আক্রোশ। তার উপরে সমাজের চাপিয়ে দেওয়া এক বছরের অশৌচের ভার। তুমি অশুচি। কারণ তুমি শোকগ্রস্থ। এও দুর্বল মনকে কি করে ঘিরে ধরে দেখেছি। মা চলে যাওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই আমার এক অত্যন্ত কাছের মানুষের মেয়ের বিয়ে। আমি না যাওয়ার অজুহাত খুঁজছি। তাকে বলি কি করে আমার মনের মধ্যে এক অযৌক্তিক ভয় দানা বেঁধেছে, আমি গেলে যদি আপনার অমঙ্গল হয়! আমি যে অশুচি! আমার যে মাতৃশোক! সমাজ এমনভাবে দুর্বল করে। আমি কোনোদিন তর্পণ করিনি। করবও না। আমার প্রাণের ভাষা আর প্রাণের আবেগই আমার তর্পণ। তার জন্যে কোনো পুরোহিত বা সংস্কৃত মন্ত্র বা গঙ্গাজলে আমার আস্থা নেই।
একদিন মেঘ কাটে। অল্প অল্প করে আলোর রেখা দেখা যায়। যখন বোধ হয়, আমি শুধু না, যুগ যুগ ধরে মানুষ এমনই শোক বুকে নিয়ে সংসারে হেঁটে আসছে। আরো আরো গভীর শোক, সান্ত্বনাহীন আরো কত কত দুঃখকে অতিক্রম করে হেঁটে আসছে। তখন মনে হয় তাদের ধৈর্য, স্থৈর্যের পায়ে মাথাটা নীচু করে তাদের সঙ্গে আমিও পা মেলাই। যা ক্ষতি হয়েছে তা হয়েছে। হয় তো আরো অনেক ক্ষতি, অনেক দুঃখ সামনে অপেক্ষা করছে। কিন্তু জীবনটাকে বাইপাস করে তো বাঁচা যায় না। নিজের বোধের আগুনে নিজেকে না পুড়িয়ে নিলে ধার করা কথায় আর ধার করা অনুভবের উপর ভর দিয়ে কি চলা যায়? ভরাডুবি হয়। কপটাচারী হয়। দুঃখের হাত থেকে ত্রাণের উপায় খোঁজা মূর্খামি। জীবনকেই অস্বীকার করতে চাওয়া প্রকারান্তরে। তা আরো দুর্বল করবে। জীবনের মূল স্রোতে নিজেকে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলবে। সে থাক বরং। সুখ না থাকুক, স্বস্তি থাকুক। চিন্তা, অনুভব, সিদ্ধান্ত, ভালোবাসা মঙ্গলানুগামী হোক। যা ভালো তাই হোক। যা শুভ তাই হোক। সেটুকুই তো মানবিকতার পায়ের তলার মাটি।