গীতা কি সহস্র কণ্ঠে আবৃত্তি করার বই? গীতায় দেখানো হচ্ছে ভগবান ও তার কনফিউজড ভক্ত কথা বলছেন নিজেদের মধ্যে। ভক্তের কনফিউশান টেম্পোরারিলি কাটল। টেম্পোরারিলি এই জন্যে বলছি তিনি যুদ্ধের পর সব ভুলে গিয়েছিলেন। ভগবানকে আবার গোটাটা বলতে বলেছিলেন। ভগবান বলেন সে আমার যোগাবস্থায় বলা, এখন আর পারব না।
কিন্তু সে অন্য কথা। এমনিতে আমরা বাঙালিরা যে খুব ঘরে ঘরে গীতাপাঠ করি তা তো দেখি না। হ্যাঁ মারা গেলে বুকের উপর একটা গীতা থাকে। শ্রাদ্ধতে একটা গীতা দেওয়া হয়। সঙ্গে পৈতে, সুপারি, সন্দেশ আর একটা টাকা সোনালি পাতলা ফিনফিনে একটা থালায় করে দেওয়া, এই তো দেখেছি। আর শ্রাদ্ধের সময় কেউ একজন গীতাটা গোটা পাঠ করেন। মাঝে মাঝে লিকার চা খান। কারণ খালি পেটে দুধ চা খেলে গ্যাস হবে। আর যে গীতা পাঠ হয় আর যে গীতা দেওয়া হয় তার মধ্যেও বিস্তর ফারাক এও দেখেছি। যেটা দেওয়া হয় সেটার মধ্যে কোনো অনুবাদ থাকে না। একটা বড় পিনে আটকে, খুব ম্যাড়মেড়ে একটা ছবি সামনে দিয়ে বইটা ছাপা হয়। অনেক জায়গায় বিস্তর ভুলভ্রান্তি, মায় কিছু সময় কোনো অধ্যায় বাদ পড়ে যায়।
এ ছাড়া গীতাপাঠ তো তেমন বাঙালির ঘরে দেখিনি। তাই গীতাপাঠ হবে শুনলেই কানে “মধু বাতা ঋতায়তে” এইসব বাজতে থাকে। কি করব, অভ্যাস যে!
তবে বাঙালি ভীষণ সুন্দর চণ্ডীপাঠ করে, এ আমি বহুবার শুনেছি। কিছু কিছু জায়গায় পড়তে গিয়ে গলা বুজে পাঠকর্তা সাশ্রু নয়নে “মা মা” করে উঠেছেন এও দেখেছি। মহালয়াতে বীরেন্দ্র স্যার এমন একটা সুর আর আবেগ বেঁধে দিয়েছেন না, অনেকটা সেই পঁচিশে বৈশাখে “হে নূতন” এর মতন। শুনলেই কান্না পায়। মনটা সোজা উদাস। তো সেই চণ্ডীপাঠ যদি সহস্র কণ্ঠে হয় তবে সে পরম সুন্দর হয়। কারণ সে তো মায়ের স্তব। মেলা স্তব আছে। গীতায় যেখানে এগারো নাম্বার অধ্যায়ে “স্থানে হৃষীকেশ”… ইত্যাদি একটাই স্তব।
তো যেটা বলছিলাম বাঙালির গীতাচর্চা। তো শ্রাদ্ধ ছাড়া আর কি মনে পড়ছে? ওই যে গো, সেই বিপ্লবীরা গীতা পড়তেন না? সে আছে। কিন্তু সে বিপ্লব, ফাঁসি এখন আর কই?
বাঙালিদের বইয়ের দোকানে সব চাইতে পপুলার যে গীতাটা পাওয়া যায়, সেটা হল জগদীশ চন্দ্র ঘোষের গীতা। তার নানা সংস্করণ আছে। আমি ছোটোবেলায় বুঝতাম না “রাজসংস্করণ” মানে কি? রাজারা যেটা পড়তেন? কোন রাজা? পরে অবশ্য বুঝলাম সব চাইতে মোটা বইটাকেই রাজসংস্করণ বলে। তাছাড়া রামকৃষ্ণ মিশনের লাল মলাট গীতা। ইস্কনের “যথার্থ” গীতা, যা গাড়িতে করেও বিক্রি হয়। এই সব আছে। আর আছে প্রচুর পদ্যগীতা। বেশ কয়েকটা পড়ে দেখেছি, অনেকগুলো কৃষ্ণ নিজে পড়েও কনফিউজড হতেন। তবে বেশ কিছু ভালোও আছে। তবে সেগুলো বেশিরভাগই সিংহাসনে চন্দনের টিপে মাখা হতে হতে আর পাঠযোগ্য থাকে না।
আরেকটা মজার কথা আছে দেখেছি। বাঙালির অনেক মনগড়া তত্ত্বকথা গীতায় আছে, এমন ধারণা দেখেছি। আমাকে একজন যেমন বললেন, একি তুমি বিয়ে করোনি কেন? গীতায় লেখা আছে অবশ্যই বিয়ে করতে হয়! তিনি বাবার রক্তপরীক্ষার জন্য রক্ত নিতে এসেছিলেন, বয়েস পাঁচের ঘরে। আমি আর কি বলি? হাত কচলে বললাম, এ হে, ওটা পড়া হয়নি তো… অথবা আমার পড়া সংস্করণে হয় তো ওটা ছাপা হয়নি!
তাছাড়া বাঙালির সেলুনে, মিষ্টির দোকানে, বাড়ির দেওয়ালে একটা এক পেজে গীতা তো থাকেই। ”তুমি কি হারিয়েছ যে কাঁদছ” ইত্যাদি। উপরে লেখা থাকে “গীতার সারাংশ”। সে যে কোন গীতার সারাংশ তা ব্যাসদেব কি যিনি বা যাঁরাই গীতার লেখক হয়ে থাকুন তা তাঁর বা তাঁদেরও বোঝার বাইরে।
বাঙালি মহাপুরুষের মধ্যে আসলে তেমন কি কেউ গীতার ভাষ্য লিখেছেন? উঁহু। মহাপ্রভু ভাগবতে জোর দিয়েছিলেন। তাঁর শিষ্যেরাও তার উপর কিছু কিছু টীকা লিখেছেন। চরিতামৃতে গীতার থেকে উদ্ধৃতি আছে কিছু কিছু যদিও। বঙ্কিমবাবু কৃষ্ণচরিত্র লিখতে গিয়ে গীতার দ্বাদশ অধ্যায়ের ভক্তের যে চরিত্র বর্ণন আছে, তার প্রশংসা করেছেন আর ওই কান্নাকাটি মার্কা ভক্তিকে এক হাত নিয়েছেন। শ্রী অরবিন্দ গীতাভাষ্যে করেছেন বটে, কিন্তু সে তো ইংরেজিতে। রবীন্দ্রনাথ অল্প কিছু জায়গায় গীতার কথা লিখেছেন। বিশেষ করে চারুচন্দ্রবাবুর করা “ধম্মপদ” এর অনুবাদের মুখবন্ধ লিখতে গিয়ে। এ ছাড়া গীতা নিয়ে বাঙালি সাধক কি পণ্ডিতকূল খুব কিছু লিখেছেন বলে মনে পড়ছে না। করে থাকলেও আমার জানা নেই, বা বাইরে তেমন আসেনিকো। ওদিকে মহাত্মা গান্ধী, তিলক যেমন গীতার ভাষ্য-টীকা লিখেছেন। এত ব্যস্ততাতেও। জেলে বসে।
তবে দাঁড়ালোটা কি? বাঙালি গীতাটা কখন পড়ে? না শ্রাদ্ধশান্তিতে। বাঙালি নানা গুরুর সম্প্রদায় যা আছে, মানে দীক্ষিতেরা, যেমন রামকৃষ্ণ মিশন, ইস্কন ইত্যাদিরা তারা কেউ কেউ পড়েন। তবে আপামর বাঙালির সঙ্গে তেমন মিশ খায়না। হিন্দি বলয়ে যেমন রামচরিতমানস বহুমানুষের স্মৃতি-জিহ্বাতে অবস্থিত। বাঙালির তেমন কোনো শাস্ত্র নেই।
আমাদের রামকৃষ্ণদেব বলছেন গোটা গীতাটা পড়ার কি দরকার? ওটা বারবার বললেই ওর সবটা মানে আছে ওতে। মানে গীতা গীতা দশবার বললে যে তাগী তাগী হয়ে যাচ্ছে কথাটা, ওটাই আসল। মানে সব ত্যাগ করো।
হাই সব্বনাশ! বলি ও ঠাকুর, ওই সহস্রকণ্ঠে যদি ত্যাগের বাণীই প্রধান হবে, তবে এত সন্ন্যাসী যাবে কোথায়? আর যদি বলো মনে ত্যাগ… তবে অমন উদাসী সংসারী নিয়ে হবেটাই বা কি!
যদি বলো পুণ্য হবে। তবে সে একটা কথা হল। সে না তো চোখে দেখা যায়, না মাপামাপির কোনো ব্যবস্থা আছে। কিন্তু গীতার শেষে অর্জুনকে যে কৃষ্ণ ঠাকুর একটা সতর্কীকরণ বাণী দিয়েছিলেন, যে এই শাস্ত্র তুমি তপস্যাহীন, অভক্ত আর আমাতে অসূয়াযুক্ত মানুষকে বলবে না। এ অত্যন্ত গোপনীয় শাস্ত্র। তার বেলা কি হল? বলি আমাদের ঠাকুরের কপিরাইট নেই বলে যা ইচ্ছা তাই করবে? হ্যাঁ গা, ঠাকুর যে একে একান্তে, সশ্রদ্ধায়, গভীরে শুনতে বলেছিলেন। মাঠে মাইক লাগিয়ে সহস্রজনে কবে পড়তে বললেন গো?