মূল - 'অকোচ্ছি মং, অবধি মং, অজিনি মং, অহাসি মে', যে চ তং উপনয হস্তি, বেরং তেসং ন সম্মতি ।
অনুবাদ - আমাকে আক্রোশ করিল, আমাকে প্রহার করিল, আমাকে জয় করিল কিংবা আমার [সম্পত্তি] হরণ করিল, — যাহারা এইরূপ চিন্তা পোষণ করে তাহাদের শত্রুতার উপশম হয় না।
মূল - ‘অকোচ্ছি মং, অবধি মং, অজিনি মং, অহাসি মে, ' যে চ তং ন উপনয, হস্তি, বেরং তেপসম্মতি ।
অনুবাদ - আমাকে আক্রোশ করিল, আমাকে প্রহার করিল, আমাকে জয় করিল, আমার [ সম্পত্তি ] হরণ করিল, — যাহারা এইরূপ চিন্তা পোষণ করে না তাহাদের শত্রুতার উপশম হয়।
মূল - নহি বেরেন বেরানি সম্মম্ভী’ধ কুদাচনং,
অবেরেন চ সম্মস্তি এস ধৰ্ম্মে সনস্তনো ॥
অনুবাদ - জগতে শত্রুতার দ্বারা কখনও শত্রুতার উপশম হয় না, মিত্রতার দ্বারাই শত্রুতার উপশম হয়; ইহাই সনাতন ধর্ম ।
মূল - পরে চ ন বিজানন্তি ময়মেখ যমামসে,
যে চ তখ বিজ্ঞানস্তি, ততো সম্মত্তি মেধগা ডি
অনুবাদ - আমরা এখানে [কলহে] নষ্ট হইতেছি অর্থাৎ অনুক্ষণ মৃত্যুর দিকে যাইতেছি, [কলহপ্রিয়] লোকেরা ইহা বুঝে না; যাহারা ইহা উপলব্ধি করে তাহাদের কলহ প্রশমিত হয় ৷
এ বুদ্ধের বাণী। বাণী চিত্তের ভালো মন্দের দ্বন্দ্বজাত সিদ্ধান্ত। যা মঙ্গলে প্রতিষ্ঠিত। রোগ হলে যেমন চিকিৎসক। তেমন স্বার্থান্ধতার মোহের থেকে ত্রাণের পথ দেখায় বাণী।
গান্ধীজী যখন বলছেন, চোখের বদলে চোখ নিলে জগত অন্ধ হয়ে যাবে। তখন সে বাণী।
সত্যজিৎ রায় যখন লিখছেন, "রাজ্যে রাজ্যে পরস্পরে দ্বন্দ্বে অমঙ্গল, তোরা যুদ্ধ করে করবি কি তা বল", তখনও সে বাণী।
বাণীতে দরদ থাকে। সহমর্মিতা থাকে। আলো থাকে। জীবন থাকে।
স্বার্থে উন্মাদনা থাকে। অন্ধত্ব থাকে। বীভৎসতা থাকে।
ইজরায়েল প্যালেস্টাইনের শত্রুতা প্রাচীন। কিন্তু যে মানুষগুলো প্রতি মুহূর্তে মারা যাচ্ছে তারা শতাব্দী প্রাচীন না। সে মায়েরা তাদের শিশুদের হাতে শিশুদের নাম লিখে দিচ্ছে, যাতে কবরে চেনা যায়, তারা কেউ ইতিহাস নয়, রাজনীতি নয়, কূটনীতি নয়। তারা মানুষ। শরণার্থী শিবিরে যারা গতকাল মারা গেল, তারাও মানুষ। কোনো নীতি না, তত্ত্ব না।
মানুষের চিত্ত সুব্যবস্থিত নয়। তার মধ্যে সু আর কু দুই-ই আছে। এ আর রহমন যখন অস্কার গ্রহণের মঞ্চে, তখন এই কথাটাই বলে বলেছিলেন, এই দুইয়ের মধ্যে আমি সু- কে বেছেছি। মঙ্গলকে বেছেছি।
কিন্তু নেতানেয়াহুর চিত্ত ব্যবস্থা সহজ নয়। সে হামাসের প্রতিশোধ নিতে প্যালেস্টাইনকে নিশ্চিহ্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাতে কার মঙ্গল সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা প্রতিশোধ। বলছেন, যদি হঠাৎ করে আমি এই যুদ্ধ থামিয়ে দিই, তবে সেটা হামাসের কাছে নতি স্বীকার হবে।
তাই হয়। এত এত নিরীহ প্রাণের কথা তার আর মাথায় নেই এখন। চোখেও পড়ছে না। তার চোখে একটাই লক্ষ্য, হামাস। গোটা প্যালেস্টাইন এখন হামাস। অনেক রাজনৈতিকদের মতে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির অভিযোগাবলী এসেছিল, তিনি এই সুবাদে তার থেকে বেরোবার একটা রাস্তা পেয়েছেন। নিজের জমি শক্ত করছেন। বেশ কিছু খবরে এসেছে যে শেষ কয়েক বছর ইজরায়েল তার সীমান্ত প্রহরায় কি অযৌক্তিক শিথিলতা এনেছিল। সেকি অবাস্তব আত্মতৃপ্তির জন্যে? নিজেদের অপরাজেয় ভাবার কারণে?
কিন্তু সে আলাদা কথা এখন। কথামৃতে একটা কথা আছে। রামকৃষ্ণদেব বলছেন, হনুমান যখন লঙ্কা জ্বালিয়ে দিল, তখন তার খেয়াল হল না যে ওই লঙ্কায় সীতাদেবীও আছেন। ক্রোধ এমনই অন্ধ করে মানুষকে।
নেতানেয়াহুর ক্রোধ, প্রতিশোধস্পৃহা এখন এমন এক বীভৎসতায় পৌঁছেছে যে তা লঙ্কা জ্বালানোর সামিল।
রণনীতি আগে ছিল। এখন নেই। এও অনেকের মত। এখন যে যত নিরীহ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে সে তত শক্তিশালী। হামাস যা করেছে তা নৃশংস বর্বরোচিত। গাজার সাধারণ মানুষ এতদিন ধরে হামাসের শাসনাধীনে। তাই তারা সবাই হামাস এখন, নেতানেয়াহুর সহজ সমীকরণ।
অনেকে লিখছেন এ সমস্যা আরো কয়েক শতাব্দী ধরে চলবে। হয় তো চলবে। ইতিহাস, রাজনীতি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে। কে ঠিক, কে ভুল তা নিয়ে কেউ-ই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছাবে না। কিন্তু একটা সহজ বাস্তব কথা আমাদের তথ্য বোঝাই শিক্ষা আমাদের কিছুতেই বোধের সামনে আনবে না, যারা মারা যাচ্ছে তারা সাধারণ মানুষ। তারা ইতিহাসের পাতা না, রাজনীতির কূটনৈতিক চাল নয়।
একদিন যুদ্ধক্ষেত্র স্থির ছিল। যুদ্ধ হত সেনায় সেনায়। এখন গোটা জগতকে যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে, অসহায় নিরস্ত্র মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে নিজের শক্তি-ক্ষমতার প্রদর্শনের লালসাকে চরিতার্থ করতে চাইছি।
সেদিনের বুদ্ধ থেকে, আজকের মহাত্মা, লুথার কিং হয়ে রাসেল, নোম চমস্কি অবধি যে অহিংসাকে, আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাকেই সভ্যতাকে রক্ষা করার বুনিয়াদ বলেছেন, তাদেরকে অস্বীকার করাই যায়। টয়েনবির ভাষায় তবে সে নিজের রিস্কে। কারণ তারা অসহায় নয়। কারণ সত্য তাদের সহায়। কোনো শাস্ত্র নয়। মানুষ নিজের হৃদয়ে সত্য-শুদ্ধ উদ্দেশ্যে কান পাতলেই শুনবে, শান্তিই পরম সুখ। সব সুখের মূল। শান্তি আর হিংসা, শান্তি আর ক্ষুদ্রতার কোনোদিন সহাবস্থান হয় না। হিংসা নির্মূল হয়ে যাবে না। তবে হিংসার মূল্য দিতে দিতেই মানুষ অহিংসার সত্যকে আবার আবিষ্কার করবে। রামকৃষ্ণদেবের ভাষায়, নিজেকে জানলে মানুষের হিংসাবৃত্তি চলে যায়, সোনার তরবারি হয় সে। যা দিয়ে হিংসা চলে না।
হয় তো একদিন তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও আবিষ্কার করবে এ সত্য যে, শত্রুতার দ্বারা শত্রুতার সমাধান হয় না, যখন তারা তাদের পূর্বপুরুষকৃত ক্ষয়ক্ষতির পরিণাম দেখবে। তারাও হয় তো বা চাইবে দুই দেশের মধ্যে সীমান্তের মর্যাদা রক্ষা হোক। হয় তো তাদের দেশেও একদিন শান্তির কথা বলার মানুষ জন্মাবে। দুই দেশের মধ্যে মৈত্রী স্থাপন হবে। ইতিহাসকে পুনরাবৃত্তি করাই দুর্বলের যুক্তি। কিন্তু ইতিহাসের মোড় ঘোরানোই সবলের সিদ্ধান্ত। আর ইতিহাসের গৌরবের অধ্যায় তো তাদের নিয়েই। আশা করতে দোষ কি?
অবাস্তব? তা হোক। এত এত নিরীহ মানুষের হত্যার মধ্যে যদি গোটা জগত নিশ্চিন্তে নিজের নিজের বেড়াজালে আমোদে-প্রমোদে দিন কাটাতে পারে, সে যদি অবাস্তব না হয়, তবে এ প্রত্যাশাও অবাস্তব নয়।