Skip to main content

অপমানিত হওয়ার অভিজ্ঞতা সংসারে নেই এক পাগল আর শিশু বই কে আছে? এমনকি দেবতারাও অপমানের বদলা নিতে কি ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটিয়ে থাকেন তারও অজস্র উদাহরণ শাস্ত্র ঘেঁটে বার করাটা বিচিত্র কিছু নয়। আর এই ফেসবুকের যুগে সে অপমানের প্রথা, মাত্রা, কৌশলের তো নিত্য নতুন আবির্ভাব। এমনকি তা আত্মহত্যা অবধিও গড়াচ্ছে এমনই তার প্রভাব। আজ যে কথাটা বলব বলে লিখতে বসলাম তা হল সে যুগের অপমানের এক উদাহরণ।
        অপমানের জ্বালা অসহ্য। আর তা যদি অকারণে হয়। বুদ্ধদেব বলছেন, তুমি যদি পরুষ বচনের ধার বিনা প্রতিকারে সহ্য করে নিতে পারো, তবে তুমি নির্বাণপ্রাপ্ত হয়েছ, তুমি নিজেও জানো না। এবার ঘটনায় আসি। 
        'অবতার' নামক এক পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের সম্বন্ধে একটা কুৎসিত মন্তব্য প্রকাশ করা হয়। যাতে বলা হয়, রবীন্দ্রনাথ যৌবনে কুৎসিত যৌনব্যাধিতে ভুগছিলেন। আরো নিশ্চয় এই ধরণের কিছু লেখা হয়, যার দরুন রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়েন, আর কয়েকটা পত্রে এই উক্তিগুলোর তীব্রভাষায় প্রতিবাদ জানানোর জন্য অনুরোধ করেন। কথাটা এত অবধি হলে এ প্রসঙ্গে লিখতে বসতুম না, কথাটা হল যে ভাবে তিনি নিজেকে এই ঘূর্ণী থেকে রক্ষা করেন ও চিত্তের ক্ষুব্ধতার থেকে শান্তির পথে এগোন।
        প্রথমে প্রতিবাদের চিঠিগুলোর নির্বাচিত অংশে আসি, ২রা অক্টোবর ১৯২৮ সালে রাণী মহলানবিশকে লেখেন - “'অবতারে' আমার নামে অদ্ভুত কলঙ্কারোপের কথা প্রথম শুনবামাত্র হিংস্র প্রবৃত্তি জেগে উঠল - সেটা আদিম যুগের পশু, বড় রকমের ঘা খেলেই ঝোপের ভিতর থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসে। মনে হল এতবড় মিথ্যুককে শাস্তি দেওয়াই চাই। সেদিন রাত্রি দুটো থেকে সকাল পর্য্যন্ত ক্রোধের উত্তেজনায় ঘুমই হল না।”
        অপর একটি পত্র প্রশান্তচন্দ্র মহালনবীশকে লেখেন, 
"'অবতার' নামক পত্রে আমার নামে অভাব্য অকথ্য অশ্লীল কুৎসা রটনা করা হইয়াছে। আমার পক্ষে পরম বেদনার কারণ এই যে, আমি ছাড়া আমার দেশের দ্বিতীয় কোনো খ্যাতিনামা ব্যক্তির সম্বন্ধে এরূপ বীভৎস মিথ্যা প্রচার করিতে কোনো নির্লজ্জ নিন্দাব্যবসায়ী সাহস করিতেই পারিত না। যে দেশে আমার বিরুদ্ধে এমন অকল্পনীয় নীচতা কুত্রাপিও সম্ভবপর হইয়াছে সে দেশে নিঃসন্দেহে অনেক লোকে এরূপ মিথ্যোক্তি বিশ্বাস না করিলেও ইহা লইয়া আনন্দবোধ করিবে এবং আমার প্রতি বিদ্বেষবুদ্ধির প্রবলতায় একথা ভুলিতেও দ্বিধা করিবে না যে, আমার নামে এতবড় কলঙ্কে সমস্ত পৃথিবীর সম্মুখে ভারতবর্ষকেই পঙ্কলিপ্ত করা হইতেছে। যে মাটিতে জন্মিয়াছি সে মাটির দুঃখদুর্ভাগ্য ও গ্লানি অগত্যা আমাকে বহন করিতেই হইবে এবং যে নিন্দার উদ্ভব অসম্ভব ও প্রতিবাদ অনাবশ্যক হওয়া উচিত ছিল তারও প্রতিবাদ করার অপমান আজ আমাকে স্বীকার করিতে হইল।” 
        এ ছাড়াও আরো তিনটে চিঠি আছে। মোটামুটি ভাব একরম বলে আর আলাদা করে উদ্ধৃতি দিলুম না। তবে স্মরণ করতে অনুরোধ করি ইদানীং বাজারে প্রচলিত অত্যন্ত জনপ্রিয় রবীন্দ্রনাথের উপর এরকমই কেচ্ছাকাহিনীমূলক বইয়ের কথাগুলো। উপরের চিঠিটার কথাগুলো খুব করে মনে হচ্ছে, - 'সে দেশে নিঃসন্দেহে অনেক লোকে এরূপ মিথ্যোক্তি বিশ্বাস না করিলেও ইহা লইয়া আনন্দবোধ করিবে'। ওনার অনুমান মিথ্যা হয় নি, আধুনিক কালের বইমেলাগুলোতে ঘুরলেই স্পষ্ট হয়। কি ধরণের বই সেখানে লোকে উৎসাহ সহকারে কিনছে আর রবীন্দ্রনাথকে আরো 'গভীরে' জানার প্রয়াস পাচ্ছে। অর্থাৎ, অন্তর্বাস না খুলে দেখলে আমরা শুধু তার সৃষ্টির উপর নির্ভর করে তার মননের গভীরতায় প্রবেশের শিক্ষা সেকালেও পাইনি, আজও পাইনি যে!
সে যাক, যে কারণে এই লেখার অবতারণা। মাত্র দুদিনের মধ্যেই ওনার আরেকটা চিঠি রাণী মহলানবিশের কাছে পৌঁছায়, সেটা পড়া যাক, ৪ঠা অক্টোবর, ১৯২৮ লিখছেন, "পর্শু তোমাদের কাছে 'অবতার' সম্পর্কীয় যে চিঠি পাঠিয়েছি সেটাও আমার পছন্দ হচ্চে না। সেটাতে যতটা ক্ষোভ আছে তাকে স্থায়ী আকারে রাখতে চাই নে। কেননা, সে অত্যন্ত ক্ষণিক। আজ ভোরে উঠে পূর্বদিকে তাকিয়ে দেখলুম পৃথিবীর প্রাত্যহিক খেয়া নৌকটি অন্ধকারের পাড় থেকে আলোর পাড়ে আর একবার এসে লাগল। 
        এমনি করেই দিন রাত্রির পারাপার হতে হতে আমিও পৌঁছবো আমার শেষঘাটে - সেও যে খুব বেশি দেরি আছে তা নয়। এমনি সুন্দর করেই শেষ করতে হবে - যেতে হবে আলোর ঘাটে - প্রতিদিনের ময়লা হাতের দাগগুলো সর্ব্বাঙ্গে নিয়ে কি সেখানে যাওয়া যায়?”
        চিঠির শেষ অংশে এও যোগ করছেন যে, প্রতিবাদ মাত্রই যদি না ছাপতে চাও তাতেও আমি আপত্তি করব না।


        রবীন্দ্রনাথের এ অসম্ভব অপমান থেকে নিজের চিত্তের উত্তরণ ঘটাতে কয়েকদিন লেগেছিল। আমাদের না হয় কয়েক মাস লাগুক, তবু ওই শেষের কথাগুলোর তো কোনো বিকল্প দেখিনে সংসারে। ফার্স্টবয় না হয় নাই হতে পারলাম, তা বলে কি ফেলুবয় হতে হবে? পাশ যে করতেই হবে, নইলে ভগবানকে না হোক, রবীন্দ্রনাথকে মুখ দেখাব কি করে? ঋণের তো শেষ নেই, সবই তো ধারে চেয়ে নিয়ে কাজ চালাচ্ছি। কিনব যে সে সামর্থ্য কোথায়?