এই তোদের এতদিন হল বাচ্চা হচ্ছে না কেন রে? দেখ ওদের তো তোদের পরে বিয়ে হল, তা-ই হয়ে গেল, তোদের?
প্রশ্নটা স্বাভাবিক। কারণ আমাদের সমাজে সীমারেখার বোধটা খুব অস্পষ্ট। কোন প্রশ্ন করতে হয় আর কোন প্রশ্ন করাটা অস্বাভাবিক, সেটার বোধ আমাদের খুব একটা স্পষ্ট নয়। আমার কি জানার অধিকার নেই? নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু কৌতুহলের অধিকার নেই।
আজকে একটা খবর আছে, একজন মানুষ, সে মোটা বলে আর তার বাচ্চা হচ্ছিল না বলে বাড়ির লোকে এত এত কথা বলত যে সে আত্মহত্যা করেছে। অবশ্যই এটা বড় খবর নয়। এর চাইতে অনেক বড় খবর দেশে ঘটে। কিন্তু দেশ আর সমাজের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। সমাজে যা ঘটে তার অনুমোদন থাকে বলেই ঘটে। আর সে অনুমোদন বিবেক দেয় না, দেয় অভ্যাস। একদিন আমাদের সমাজে অনেক অনেক অমানবিক ঘটনা ঘটে যেত, সে সবের প্রতিবাদ আমাদের চিত্তে জাগলেও, করা অবধি ঘটে ওঠেনি, কারণ করাটা সমাজের দ্বারা প্রভাবিত হয়।
বাচ্চা না হওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। এক, নিজেদের সিদ্ধান্ত; দুই, শারীরিক সমস্যা। দ্বিতীয়টার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের বেশ কিছুটা অগ্রগতি হলেও সে পদ্ধতিগুলো শতাংশে সফলতা দেয় না।
কিন্তু কারণ যাই হোক, প্রশ্নের সামনে পড়তেই হবে। একজন মহিলা কেন দীর্ঘদিন অবিবাহিত থেকে গেল, এ নিয়েও যেমন অনেক হাইপোথিসিস তৈরি হয়, তেমনই বাচ্চা না হওয়ার কারণ হিসাবেও অনেক হাইপোথিসিস দাঁড় করানো হয়। কিছু হাতে গোনা পরিবার সহজে মেনে নেয়, বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই গলার কাঁটার মত বিঁধে থাকে। রাস্তায় বেরোলে পাড়া-প্রতিবেশীরা জিজ্ঞাসা করে, কি গো নাতিপুতি কবে হবে? ওরা কি ভাবছে? প্রশ্নটা অনেক সময় না করেও সুকৌশলে করা যায় তাও দেখেছি। কোনো একটা অনুষ্ঠানে কোনো বয়স্ক দম্পতির সামনে ঘটা করে নাতি-নাতনিদের গল্প শুরু হয়ে গেল। যারা শুনছে তারা বিব্রত বোধ করছে। যারা বলছে তারা এক অনির্বচনীয় সুখ পাচ্ছে।
এর কারণ মানুষের মধ্যে অন্যকে বিব্রত করায় এক সুখ আছে। অন্যকে বিড়ম্বনায় ফেলা, অন্যকে অপদস্থ, অপ্রস্তুত করার মধ্যে একটা সুখ আছে। যার লাইট ভারসান আমরা আমাদের বন্ধু মহলে 'লেগ পুলিং' বলি। সেটা অবশ্যই আমোদের জন্য। সে মাত্রাবোধ আমাদের আছে বলেই সেখানে একটা সুখ, মজা। কিন্তু প্রবৃত্তিটা একই, অন্যকে বিব্রত করার সুখ। রবীন্দ্রনাথ 'পঞ্চভূত' প্রবন্ধে কৌতুকের সংজ্ঞায় বলছেন না, যা আমাদের কৌতুকের বিষয়, মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে তাই আমাদের অত্যাচারের কারণ হয়ে ওঠে। উদাহরণ হিসাবে বলছেন, চড়ুইভাতি যেমন, অসময়ে, অরন্ধিত খাবার, কিন্তু তার মধ্যে আমোদ আছে, যদি না সে মাত্রা ছাড়িয়ে রোজকার ঘটনা হয়ে ওঠে।
সেই দাদু-দিদা, ঠাকুমা-ঠাকুর্দা এবার বাড়ি এসে সেই বিব্রত হওয়ার শোধ তুলবে অভিমানে, প্রশ্নের পর প্রশ্নে, অপমানে। কারণ তাদের কাছে প্রতিবেশীর প্রশ্নগুলো অস্বাভাবিক লাগবে না, কারণ সেটা সমাজ অনুমোদিত। অস্বাভাবিক লাগবে বাড়ির সেই নিঃসন্তান দম্পতিদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে, তাকেই দৃষ্টিকটু লাগবে।
আমাদের পৌরাণিক উপাখ্যানগুলো যদি দেখা যায়, সেখানে দেখা যাবে যে, তাদের সব সুখ ছিল, কিন্তু ঈশ্বর তাদের সন্তান না দেওয়ায় তারা ভীষণ দুঃখী ছিলেন। দশরথ থেকে শুরু করে ঠাকুমার ঝুলি অবধি কেউ মুনিঋষির কাছে যাচ্ছে, কেউ অসুর দেবতার কাছে যাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ, এ রীতিমতো চর্চার বিষয়। আলোচনার বিষয়, এতো আমাদের আদিকাল থেকেই।
এখন আমার প্রশ্ন আন্তরিক হলেও অন্যকে বিব্রত করার জন্য হয় তো যথেষ্ট, যদি সে নিজে থেকে এ নিয়ে আলোচনা করতে না চায় তো। আজকের যে খবরটা দিয়ে শুরু করলাম, সে ঘটনাটা তো আমাদের অজানা নয়।
"আমি তো চিন্তিত বলেই প্রশ্নটা করছি", এ কথাটা নিশ্চয়ই মিথ্যা নয়। সত্যিই কারোর মনে হতে পারে, ভীষণ জেনুইনভাবেই মনে হতে পারে। কিন্তু তবু সেই জেনুইন সার্টিফিকেটও এই ক্ষেত্রে অচল। আমাদের সব জেনুইন আবেগ, ইচ্ছা কি ভালো? নয় তো। এক সুগারের রুগীর জেনুইনলি মিষ্টি খেতে চাওয়ার ইচ্ছাটা কি ভালো? নয় তো। সেরকম ভালো করে ভেবে দেখলে দেখা যাবে যে অনেক অনেক জেনুইন ইচ্ছাই আদতে ঠিক নয়। এ ক্ষেত্রেও তাই।
সীমারেখা মানা অভ্যাস করতে হবে। শুরুতেই যে বললাম না, আমাদের সীমারেখার বোধটা ভীষণ অস্পষ্ট। আমাদের ধর্ম সমাজে ঢুকে বিধান দেয়। আমাদের সমাজ ধর্মের নীতিকে লাভের নীতি বানাতে তৎপর হয়ে ওঠে। আমাদের পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন থেকে থেকেই দিক বদল করে। অন্দরমহলের প্রশ্ন বাজারে আলোচনার বস্তু হয়। বাজারের তত্ত্ব বিজ্ঞানের, ধর্মের, নীতির ছদ্মবেশে অন্দরমহলে ছড়ি ঘোরাতে আসে। মুশকিল হল সবাই বলে, সে আমার আপনজন বলেই যে না এত ভাবছে, এত প্রশ্ন করছে। কিন্তু আদৌ এই আপনজনকে সংসারে বুঝতে পারা কি এতই সোজা ব্যপার রে ভাই? নিজে নিজের আপনজন না হতে পারলে, এ বিশ্বসংসারে কেউ-ই আপনজন হয় না - স্বয়ং ভগবানও না, এ কথাটা না বুঝলে নিজেই নিজের জীবনে সাইডরোলে অভিনয় করে যেতে হবে, নইলে ত্রাণ নেই সমাজের আপনজনদের হাত থেকে আর।