Skip to main content

মহাত্মা না সেলিব্রিটি? নাকি দুই-ই? একবার বাণী বসুর একটা সাক্ষাৎকারে উনি বলেছিলেন, লেখালেখির জগতে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে, এ দুয়ের সাযুজ্য খুব কমক্ষেত্রেই দেখা যায়। এ প্রসঙ্গ বিতর্কের। কিন্তু যা বলতে চাইছি সেটা তর্কের জন্য না মোটেই। 
আমাদের সারাদিন ঘিরে নানান বিখ্যাত মানুষ। যিনি যে পরিমণ্ডলে বিচরণ করেন, তাঁর সেই পরিমণ্ডলের বিখ্যাত মানুষেরা তাঁকে ঘিরে। মহাপুরুষ বা গুরু, লেখক, রাজনীতিবিদ, অভিনেতা ইত্যাদি যে কোনো পথেরই হোন না কেন। তবে মহাত্মা কি? মহাত্মা মানে কি মহাপুরুষ? হ্যাঁ-ও, আবার না-ও। আজ যাঁদের মহাপুরুষ বলছি, তাঁদের সময়ে তাঁরা হয়তো সাধারণের থেকে কিঞ্চিৎ বেশি পরিচিত ছিলেন, অথবা একদমই সেরকম অর্থে পরিচিত ছিলেন না। খ্রীষ্টকে চিনতেন কিছু মানুষ, মানতেন মুষ্টিমেয় ক'জন। রামকৃষ্ণদেব, সক্রেটিস, কবীর ইত্যাদির ক্ষেত্রেও তাই। তবে বুদ্ধ, মহাপ্রভুর পরিচিতি তাঁদের জীবিত অবস্থাতেই কিঞ্চিৎ বেশি ছিল, অনুগামীর চেয়ে শত্রুসংখ্যাও তাই কম ছিল না। তবে তাঁরা কেউই অগম্য ছিলেন না। অর্থাৎ ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ছিলেন না। মহাপ্রভু তথা বুদ্ধের সাথে দেখা করতে গেলে অগ্রীম অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা ছিল না। সে সময়ের রাজারাজড়াদের ক্ষেত্রে অবশ্যই ছিল। কারণ প্রথম পক্ষেরা মহাত্মা ছিলেন, সেলিব্রিটি ঠিক নন। দ্বিতীয় পক্ষেরা হলেন সেলিব্রিটি। 
প্রতিটা যুগের মানুষের একটা প্রশ্ন থাকে, তৃষ্ণা থাকে। আমাদের এই যুগে সেই প্রশ্ন আর তৃষ্ণা বড় বস্তুগত। চোখের জলের রাসায়নিক গঠন, প্রকার, সে বস্তুটির অভাবে কি কি করণীয় - সব প্রশ্নের উত্তর মেলা অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু সেটা কেন বেরোয়, তা বস্তগত জ্ঞানের দ্বারা মিটবে না। আমাদের দুটো শব্দ খুব গোলায় দেখেছি, 'বস্তুবাদী' আর 'বাস্তববাদী'। খ্রীষ্ট, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ বস্তুবাদী ছিলেন না, বাস্তববাদী অবশ্যই ছিলেন। আমাদের মুশকিল হচ্ছে স্থূলকে যত সহজে স্বীকার করছি, সুক্ষ্মকে ততটা সহজে নয়। তাই মনের গভীরের কথাগুলোকে, ভাবগুলোকে স্থূল সংজ্ঞায়িত করে 'মার দিয়া কেল্লা' গোছের একটা ভান করে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আর কার্পেটের তলাকে ধুলোয় ধুলোয় ভরিয়ে তুলছি। প্রশ্ন নেই, গভীরে তৃষ্ণা নেই; আছে ক্ষুধা, আছে লোভ, আছে প্রয়োগ প্রবণতা। মানুষ কি অবশেষে একটা প্রয়োগ? একজন পার্ফরমার? একজন প্রয়োজন? না তো! মানুষ অবশেষে একজন মানুষ। মানুষের অতিরিক্ত সে যা কিছু হতে গেছে, ব্যর্থ হয়েছে। একদিন দেবতা হতে গিয়ে বিকারগ্রস্থ হয়েছে (উদাঃ বৌদ্ধযুগের স্বর্ণময় সময়টার পরবর্তীকাল), আর আজ যন্ত্র সাজতে গিয়ে আরো গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। 
মানুষ এককালে যেমন প্রশ্ন করেছিল আগুন কি করে জ্বলে? বৃষ্টি কি করে হয়? তার উত্তরে সে পেয়েছিল যা, তাকে বললাম আমরা বিজ্ঞান। সে প্রশ্ন ছিল কৌতুহলের, বুদ্ধির, বহির্বিশ্বের সমস্যাজাত। যুক্তি সেখানে অগ্রগামী। মানুষের অন্তুরের অন্তঃস্থল থেকে আরেকটা প্রশ্ন জেগেছিল - আমাদের অত্যান্তিক মঙ্গল কিসে? উত্তর এসেছিল সংযম আর মৈত্রীর। তাকে আমরা বললাম ধর্ম। যাত্রা শুরু হল। দুই পথেই তৈরি হল নানান বিকার। যুগে যুগে এমন এক একজন মানুষ জন্মালেন যাঁরা সে বিকারগুলো পরিষ্কার করে আমাদের চলবার পথটাকে আবার যোগ্য করে তোলার প্রয়াস পেলেন। আমরা এগোলাম খানিকটা। আবার বিকার ঢাকল। 
সমস্যাটা বিকারে না। সমস্যাটা বিকারগুলোর প্রতি নির্বিকার থাকায়। শুরুতেই বলছিলাম না যে মহাত্মা বলতে মহাপুরুষ বা সেলিব্রিটি বোঝায় না, মহানকে অনুভব করার ক্ষমতাকে বোঝায়। সে ক্ষমতার স্থূল প্রকাশ দেখি যখন সমুদ্র কিম্বা পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলি - “আঃ... ছাড়া পেলুম!” কিসের থেকে ছাড়া পেলাম? আমার ক্ষুদ্র পরিসর থেকে। বাড়ির মধ্যেও যদি ঠাকুরঘর করি, সেই স্থানটাকে আমরা দৈনন্দিন সংসারের কোলাহল, মলিনতা থেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করি। সেখানে আমরা পবিত্র চিন্তার, পবিত্র ভাব আনার চেষ্টা করি। কেন? সেটাকেই আমরা বলেছি সাধন, তাই। নিজের ক্ষুদ্রতার কাছ থেকে মুক্ত হয়ে নিজের মধ্যে যে বড় তার কাছে যাওয়ার প্রয়াসকে বলছি ধর্ম। অবশ্য ফাঁকিবাজ সব পথেই আছে। এ ক্ষেত্রেও আমরা কোনো ছবি, মূর্তি অথবা গুরুকে বড়র প্রতীক জেনে নিজে বড় হওয়ার সাধনটাকে পাশ কাটাতে গেছি। তাতে নিজেকে ও তার সাথে নিজের পূজ্য উভয়কেই চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ করেছি। যত ক্ষুদ্র উদ্দেশ্য, আয়োজন তত বড়। তাই গীতায় যেখানে শুধুমাত্র জল, ফুল, ফল আর পাতাকেই সর্বাধিক বাহ্যিক পূজা বলছে আমরা সেখানে ষোড়শোপচারের আয়োজন করেছি। ফলও হাতেনাতে পাচ্ছি, যে এক জায়গায় মাথা নীচু করে রাখলে বিশ্বসংসারে আর কোথাও মাথা নীচু করতে হয় না, সেইখানে ফাঁকি দিয়ে সর্বত্র, যখন-তখন মাথা নীচু করছি। আর নিজেদের অত্যন্ত চালাক জীব ভেবে আত্মতুষ্টি লাভ করছি। 
জীবনের উদ্দেশ্যটা সেলিব্রিটি হওয়া তো নয়, নিজের ভিতরের অনুভবকে শুদ্ধ করার প্রয়াস। মাদার টেরেসা একটা চমৎকার কথা বলতেন, 'ঈশ্বর আমায় সফল হওয়ার জন্য পাঠাননি, বিশ্বস্ত থাকার জন্য পাঠিয়েছেন।' কি অসামান্য কথা! বলা হয় নিজের ক্ষুদ্রতার থেকে বাঁচার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হল, মহৎ অনুভবের সঙ্গে থাকা। মহৎ বাণীই হোক, জীবনীই হোক, সারাটা দিন যদি সেই সুধা থেকে নিজেকে বঞ্চিত না রাখি, তবে আমার অনুভবও একদিন সেই পবিত্র আত্মাদের অনুভবের কিঞ্চিৎ ছোঁয়া পাবে। চুম্বকের সাথে থাকতে থাকতে যেমন লোহাও চুম্বক হয়, খানিক তেমন আর কি! 
তাই খোঁজ সেলিব্রিটির না হোক, তৃষ্ণা সেলিব্রেশানের না হোক, যা বাহ্যিক আড়ম্বর শুধু। তৃষ্ণা হোক নিজেকে আরো মার্জিত, পরিশীলিত করার। শান্ত, প্রসন্ন আর সংযত করার। তবেই আমিও বাঁচি, আমার আশপাশটাও সুস্থ হয়।