বিজ্ঞান বলে কি কিছু আলাদা বিষয় আছে? সত্য আর বিজ্ঞান কি সমার্থক নয়? তেমনই কল্পনা আর ধর্মীয় গল্পগুলো কি একই নয়? কল্পনার সত্য আর পরীক্ষিত সত্যের মধ্যে বিরোধ কেন হবে? কল্পনা মানেই কি মিথ্যা? অবশ্যই নয়। কল্পনার সঙ্গে মানুষের ইচ্ছা, ভালোবাসা, কামনা বাসনার যোগ নেই? মানুষের যা কিছু সৃষ্টি সে তো আগে তার কল্পনায় এসেছে, তবে তা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। তবে কল্পনা বলেই তাকে মিথ্যা বলে চালানোর কারণ তো দেখি না। না, কারণ আছে। কল্পনার সত্যকে যখন আমি পরীক্ষিত সত্যের দরবারে নিয়ে যাই তখন তার মান সম্মান নিয়ে টানাটানি হবেই। পরীক্ষিত সত্যের দরবারে সবাই প্রমাণ পত্র চায়। এখন কল্পনা যদি বলে আমার সব সত্য অনুমানের, আমার কাছে তো প্রমাণপত্র নাই, তখনই শুরু হয় সমস্যা। কারণ সে যেখানে প্রবেশাধিকার চাইছে সেখানে প্রমাণের প্রমাণপত্র না দেখালে ঢোকার অনুমতিই নেই। কত মানুষের কত প্রমাণপত্র এ ও খারিজ করে দিল, কেউ তা নিয়ে গোঁসা করেছে বিজ্ঞানের জগতে শুনেছ? কারণ সেখানে ব্যক্তির ইগোর চাইতে প্রমাণিত সত্যের মান বেশি। তাই একের প্রমাণ অন্যের বিরুদ্ধ প্রমাণের সামনে না টিকলে, সে বিনা ইগোর লড়াইয়েই বলে, তোমারটাই সত্য।
আসলে বিজ্ঞানের সত্য তো ব্যক্তিগত সত্য নয়। সে সার্বজনীন সত্য। তাই ইগো পাত্তা পায় না। কিন্তু আমার কল্পনার সত্য তো আমার আমি থেকে সৃষ্টি করেছি, ফলে সে আমায় ছাড়া দাঁড়াতে পারে না, আমিও তাকে ছাড়া চলতে পারি না। ফলে কেউ আমার কল্পনার সত্যের বিরুদ্ধে কিছু বললেই সে সরাসরি আমার অহমিকায় এসে লাগে। মনে হয় আমায় এত অবিশ্বাস!
আসলে দেখো, প্রমাণ আর অনুমান। এতেই তো জগত চলছে। এখন বিজ্ঞান আর ধর্ম এই দুটোকে নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হল। এই জগত হল তাদের ক্ষেত্র। তা জগত তো আর দুটো নয় গা। একটাই। এক কালে এ জগত নিয়ে যা যা অনুমান করা হয়েছিল বিজ্ঞান এসে প্রমাণ করল তা তা আসলে তা নয়। অনেক কিছুর ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে শুরু করল। এখন দেখো বিজ্ঞান তো আর আমার অনুমানগুলোকে মিথ্যা করবে বলে আদাজল খেয়ে লাগেনি। তার কাজের মধ্যে দিয়ে আমার অনুমানগুলো একে একে ভুল প্রমাণিত হয়ে গেছে। সে তার কি করবে?
তবে কল্পনা আর অনুমানের মধ্যে পার্থক্য কি? সেই পার্থক্যই যা সাহিত্য আর রাজনীতির মধ্যে। দেখো কল্পনা থেকে সাহিত্য জন্মায়। কল্পনা জন্মায় অনুভব আর বাস্তবের মধ্যের অভাবটুকু পূরণ করতে। যেমন কাঠবেড়ালির গায়ে দাগ দাগ দেখলাম, এ বাস্তব। কিন্তু আমি আর কারণ তো জানি না। আমি তাই কল্পনা করলাম যে সীতার আঙুলের দাগে অমন হয়েছে। যে কারণে হনুমানের মুখ কালো হয়েছে, লেজ মুখে পুরে দিয়ে। তৈরি হল মিথোলজি। মানে বাস্তবের কাল্পনিক ব্যাখ্যা। তাই দিয়ে তৈরি সাহিত্য। বেশ লাগে পড়তে। যদি খোলা মন নিয়ে পড়া যায়। যদি স্মরণে রাখা যায় সে সময়ে মানবসভ্যতার অবস্থান। কিন্তু সেই সাহিত্যকে যদি অকাট্য প্রমাণ ধরে নিই, আমার বাপঠাকুরদা মেনে এসেছে বলে, তবে তো আমার বাপঠাকুরদাকেই লজ্জা দেওয়া। ধরা যাক এক বাড়ির লোক দারিদ্র্যর কারণে মাটিতে খাবার রেখে খেত। তারপর তাদের অবস্থা ফিরল, কিন্তু বাপঠাকুরদার প্রতি সম্মানে তারা যদি আবার মাটিতে খাবার রেখে খায় তবে সে বাপঠাকুরদাকে সম্মান করা হল, না তাদের অসহায়, উপায়হীন অবস্থাকে ব্যঙ্গ করা হল সেও তো ভাবতে হবে। সেকি লজ্জার কথা নয়!
অনুমান আর কল্পনা নির্ভর সাহিত্য মানুষকে ভালো মন্দ দুই দিয়েছে। এর কল্পনার সঙ্গে ওর কল্পনার বিরোধ হয়েছে। এক জগতে নানা জগদীশ্বর হয়েছে। তাই নিয়ে রক্তগঙ্গাও বয়েছে। অনুমান আর কল্পনা মানুষের এমন মজ্জাগত। এমন টান, আসক্তি তার উপর। কেন? আরেকটা তত্ত্ব আসে। অভ্যাস।
মানুষ অভ্যাসের দাস। এ আমরা কথায় কথায় বলি। আমাদের কল্পনা আর অনুমানের প্রতি এত আনুগত্য থাকার কারণ দুটো। এক চলে আসা অভ্যাস, দুই, বুঝতে সোজা। এখন আমি যদি বলি আপেল মাটিতে কেন পড়ল, কারণ হল মাটির মধ্যে একটা রাক্ষস আছে, সে সব কিছুকে নিজের মধ্যে টেনে নেয়। ব্যস, বোঝা কত সোজা হল। মানুষ রাক্ষস দেখেনি। কিন্তু লোভ, হিংসা, নিষ্ঠুরতার অভিজ্ঞতা তার আছে। সেই তাকেই সম্বল করে সে ধাঁ করে একটা রাক্ষস কল্পনা করে নিল। মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব বুঝতে হল না। সে তো কঠিন। তার তো নানা মাপঝোঁক আছে।
আরেকটা কথা আছে। কল্পনা সব সময় ব্যক্তি তৈরি করে। কল্পনা কখনও নৈর্ব্যক্তিক হয় না। পরীক্ষিত সত্য, যাকে বিজ্ঞান বলি, সে সব সময় নৈর্ব্যক্তিক। অনুমান আর কল্পনা সব সময় সব কিছুর ব্যাখ্যায় ব্যক্তিতে এসে মেশে। তাই না মানুষ এক কালে আগুন, বৃষ্টি, পক্স ইত্যাদি সবের স্রষ্টা তথা নিয়ামক ব্যক্তি বানিয়েছিল কল্পনায়। ব্যক্তি মানেই ইচ্ছা, দ্বেষ, অহমিকা। সেখানে নিয়ম বলে কিছু নেই। হয় কৃপা, নয় ক্রোধ। কারণ সব কিছুর উৎস ব্যক্তি। কল্পনার উৎস যেহেতু ব্যক্তির রুচি, তাই তার শেষও ব্যক্তি। রাগী মানুষের ভগবান ভীষণ নীতিশীল। কোমল মানুষের ভগবান ক্ষমাশীল। শৈল্পিক মানুষের ভগবান শিল্পী। এমন নানা ভাগ তাই। ব্যক্তির রুচিজাত কল্পনা সমান রুচি সম্পন্ন ব্যক্তিকেই তো তার ঈশ্বর বলবে। এই স্বাভাবিক।
তবে কথা হচ্ছে, এই দুটো কি একসঙ্গে চলতে পারে না? জগত যেহেতু একটাই, আর বিজ্ঞান একের পর এক সব কিছুর পরীক্ষিত ব্যাখ্যা দিয়ে যাওয়ার পর কল্পনার হাতে অবশিষ্ট জগত বড় কম। তাই ধর্ম দিন দিন এত সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাচ্ছে। কথায় কথায় সেন্টিমেণ্টে আঘাত লাগছে। আসলে এ অভিমানের কথা। তারাশঙ্করের লেখা জলসাঘরের সেই জমিদারের মত অভিমানী হয়ে উঠছে সে। অভিমান মানে তো সেন্টিমেন্ট।
তবে এই সেন্টিমেন্টকে সামলাবো কি করে? এর উত্তর আছে সাহিত্যে। কল্পনা আর অনুমানকে ঘিরে সাহিত্য সৃষ্টি চলুক না। শিল্প হোক। সেখানে তো কেউ প্রমাণ চায়নি। রুমি, রবীন্দ্রনাথ, কবীর, রামপ্রসাদ প্রমুখদের কাছে তো কেউ প্রমাণ দাবী করেননি। তারা গান লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন। নিজের ভাবে নিজে মজেছেন। মজিয়ে চলেছেন। দাবী করেননি প্রমাণপত্রের। আনন্দ সৃষ্টি করেছেন, আনন্দ দিয়েছেন। মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ তার আনন্দের সম্পদ। আনন্দ স্বতঃপ্রমাণ। তাকে প্রমাণ করতে হয় না। আমার কল্পনা, আমার অনুমান আমায় যদি আমার সৃষ্টিতে আনন্দ দেয়, সে আনন্দ যদি আমি আমার কবিতায়, গানে ছড়িয়ে দিই তবে তো সমস্যা নেই। তাই যে রাধার পদধ্বনি শুনছে নিজের কল্পলোকে, তাকে যদি গিয়ে বলা যায়, ওহে ও রাধাকে মানে না, চলো বোম বেঁধে ওকে উড়িয়ে দিই। সে কানে নেবে? নেবে না। যে আনন্দ পেয়েছে, যে নিজের সৃষ্টির সুখে মজে আছে, সে আনন্দের এমন স্রোতে অবগাহন করেছে রাজ্যের ধনরাশি, মান-সম্পদ তার কাছে তুচ্ছ। সে তৃপ্ত। সমস্যা হল, যারা বীণা হাতে ঘোরে অথচ না পারে বাজাতে, না পারে শ্রোতা হিসাবে মগ্ন হতে। সে মূর্ছনায় মজে না বলে, বীণার আঘাতে বীণার অস্তিত্বকে জানান দিতে চায়। সব কিছুকেই সে তাই শত্রুময়, বৈরিময় দেখে। আনন্দ আর নৈর্ব্যক্তিক সত্যের কোনো বৈরী নেই। বৈরী আছে অহমিকার। আর অহমিকাজাত সব কিছুর। যত সমস্যার মূলও তো সে। তাই না?