রামকৃষ্ণদেব কোনো বিশেষ ধ্যানকক্ষ চাইলেন না। কিম্বা মথুরকে বললেন না, 'ওহে সেজোবাবু, হরিদ্বারে কি হিমালয়ের গুহায় আমার জন্য একটা সাধন কুটি বানিয়ে দাও তো হে! আমি ঈশ্বর চিন্তা করব। মায়ের নামগান করব।'
সেজোবাবু, ওরফে মথুর কি না করতেন? না। অর্থ, ইচ্ছা, শ্রদ্ধাভক্তি কিছুরই কম ছিল মথুরের। হয়েই যেতে পারত। কিন্তু হল না, কারণ ঠাকুর চাইলেন না।
দক্ষিণেশ্বর। শ্যামপুকুরবাটি। কাশীপুর বাগানবাটি। তিনটিই কলকাতায়। তিনটিতেই নিজের ইচ্ছায় এলেন না। দক্ষিণেশ্বরে এলেন দাদার আদেশে, বা ইচ্ছায়। বাকিদুটোতে ভক্তদের ইচ্ছায়, চিকিৎসার সুবিধা হবে বলে।
দক্ষিণেশ্বরের ঘর, বাঁধানো উঠান, গঙ্গার ধার, আর মাঝে মাঝে গিরিশ ঘোষের বাড়ি, কি বলরাম বসু'র বাড়ি, কি কোনো ভক্তের বাড়ি। কেন? কি চাইছেন? মানুষের সঙ্গ। কথা, গান, নাচ। আনন্দ। খাওয়ার সুখ না, পরার সুখ না, বিলাসিতা না। কিন্তু চাই কথার সুখ। গানের সুখ। নাচের সুখ। আনন্দ দিচ্ছেন, অকাতরে বিলিয়ে যাচ্ছেন।
এত আনন্দের উৎস কি? কেন তুমি হাঁপিয়ে উঠছ না? কেন তুমি পাহাড়ে, জঙ্গলে, সমুদ্রের ধারে যেতে চাইছ না? তোমার চারধারে যারা আছে সবাই কি তোমার অনুগত? কেউ কি কষ্ট দিচ্ছে না? মনস্তাপের কারণ হচ্ছে না? হচ্ছে তো। কষ্ট দিচ্ছে তো। তবু এতো আনন্দের উৎস কোথায়? সঙ্গ। মানুষের সঙ্গ।
যে মানুষ ত্যাগের কথা বলে, সে মানুষ কলকাতায় পড়ে থাকে কেন? ঠাকুর বলছেন, "বজ্জাৎ আমি-কে ত্যাগ করো।"। যে আমি বলে, "আমায় জানে না!?".... "এত বড় স্পর্ধা!"
কিন্তু এ তো গেল উপদেশের কথা। সে আছে। কিন্তু তোমার তো ওসবের বালাই নেই। তোমার তো 'বজ্জাৎ আমি' নেই। তো তোমার এতসবের মধ্যে থাকার কি দরকার? তোমার তো জীবনের লক্ষ্য পূরণ হয়ে গেছে। এবার? যাও সে-ই মহৎ অনুভব নিয়ে হিমালয়ে। যাও, গিয়ে বোসো একটা আশ্রম বানিয়ে। যাও, তা না, গলায় ক্যান্সার, শরীরে ক'টা হাড় বই কিছু নেই, একজন নতুন মানুষ এসেছে, তাকেও উপদেশ দেওয়া হচ্ছে, আবার বলা হচ্ছে এখানে মাঝে মাঝে এসো, এখানে প্যালা পড়ে না! মানে পয়সা লাগে না আর কি! কেন, সে তো আর দিগ্বিজয়ী নরেন হবে না, নিতান্ত ছা-পোষা লোক। তার কি হল না হল তোমার কি দরকার? তোমার লোকের দোরে দোরে ঘোরার কি দরকার? তুমি তো দেখেছ, কিভাবে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে, সময় মেনে, নানা নিয়ম-কানুন মেনে ধর্ম প্রচার করা হয়। লেকচার দেওয়া হয়। তো নিজের জন্য একটা অমন ব্যবস্থা করে নিলেই হত!
কিন্তু এর কোনোটাই রামকৃষ্ণদেব চাইলেন না। না তীর্থ, না শান্তি, না মানযশ, না খ্যাতি।
বার্ট্রান্ড রাসেল একদম শেষের দিকে একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "কাইন্ডনেস" না থাকলে কোনো বড় মাপের দর্শন জন্মায় না। দরদী না হলে মানবিক সত্যের নাগাল পাওয়া যায় না। রামকৃষ্ণদেবের আধ্যাত্মিক বিলাসিতা ছিল না বলেই হিমালয়ের গুহায় চলে যেতে চাইলেন না। অবশ্য যারা গেলেন তাদের নিন্দাও করলেন না, একটু ঠাট্টা করলেন। অনেকে কুয়ো খুঁড়ে কোদাল-টোদাল কুয়োয় ফেলে দেয়….. কেউ কেউ আম খেয়ে মুখ মুছে ফেলে…. ইত্যাদি এই সব বলে।
মানুষে মানুষে দিন যত বাড়ছে সংঘাত তত বাড়ছে। কেউ কাউকে যেন একটু থেকে একটু হলেই সহ্য করতে পারছে না। ক্রমশ চক্ষুলজ্জা অবধি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এমনকি নিজেকেও সহ্য করে উঠতে পারছে না। আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে কি এমন পার্থক্য ছিল। সুনীল গাঙ্গুলির লেখায় সেও তো পড়েছি আমরা। রামকৃষ্ণদেব, মা সারদা ছবি, বাণীর থেকে অনেক বড় একটা দিক দেখিয়ে গেছেন। মানুষের সঙ্গে কিভাবে থাকতে হবে শিখিয়ে গেছেন। সারদাদেবীর জীবনে সে উদাহরণ ছত্রে ছত্রে। জীবনের প্রতিটা দিনেই প্রায়। সে কলকাতার শিক্ষিত শহুরে লোক, কি জয়রামবাটির তথাকথিত অশিক্ষিত লোক। তিনিও তাঁর দীর্ঘ জীবনে মানুষের থেকে ছুটি চাইলেন না। এক এক সময় হাঁপিয়ে ওঠেননি যে তা নয়। "তামাক কাটার" মত করে কাটলেও আর ফিরব না, তাও বলছেন। কিন্তু বাস্তবিক ছেড়ে যাননি। চলে যাননি।
মানুষে মানুষে সহাবস্থানের সূত্রকে, ভালোবাসার সূত্রকে, সহ্য করার, মানিয়ে নেওয়ার সূত্রকে তাঁরা ঈশ্বর বলেছেন। জীবন্ত ঈশ্বর। যে বাঁধনে সব বাঁধা। যে সূত্রে সবটা গাঁথা। আমার 'আমি'টাও বাঁধা। শুধু বজ্জাৎ আমিটা সেটা মানতে চায় না, সে নিজে সুতো হতে চায়, নিজেকে কেন্দ্র করে জগতকে ঘোরাতে চায়। ওটিই ভুল।
ঠাকুরের নশ্বর শরীর দাহ হল কলকাতায়। মায়ের হল হাওড়ায় বেলুড়ে। গঙ্গার এদিক ওদিক। পাহাড়, জঙ্গল, সমুদ্র না, দুটো জীবন। এইখানেই, এই মানুষের মধ্যেই থেকে বুঝিয়ে গেলেন, চাইলে এইখানে থেকেও হয়। শুধু খুঁজতে হবে নতুন করে, তোমার সঙ্গে আমার বাঁধনটা কিসে? টাকার দরকারে, শরীরের দরকারে? নাকি সেসব ছাপিয়েও আরো কিছু আছে?
মা বললেন, দরদ। ঠাকুর বললেন, মা।