Skip to main content
 
        তোমাদের জন্য আমার শান্তি নেই। আমার ব্যক্তিগত জীবনে শান্তি ছিল। যখন ধর্ম আমার একান্ত ব্যক্তিগত ছিল। আমার ধর্মে সেদিন আমি ছিলাম, আমার ঈশ্বর ছিলেন। সংগীত ছিল। নৃত্য ছিল। আকুতি ছিল। আনন্দাশ্রু ছিল। আমার ধর্মের মধ্যে আমি সারা বিশ্বের ছবি দেখতাম। আমার স্তব ছিল, ভজন ছিল, ফুলের সাজ ছিল। আমার উৎসব ছিল আবীরে, প্রসাদে, আনন্দে, আবেগে, কীর্তনে, নাচে। আমার প্রাণের সে আনন্দ প্রতিবেশীকে ভাই করে নিয়েছে। আমার প্রাণের সে গভীর শান্তি অন্যের ধর্ম বিশ্বাসের সাথে নিজের ধর্ম বিশ্বাস মিলিয়ে নিয়েছে। আমি তুলেছি জবা, সে তুলেছে গোলাপ, আমি তুলেছি আকন্দ, সে তুলেছে কুন্দ। আমার বাগানে যে ফুল ফোটে, আমার পাশের বাড়ির বাগানে সে ফুল ফোটে না। আবার আমার বাগানে যে ফুল ফোটে না আমার পাশের বাড়িতে সে ফুল ফোটে। আমাদের দুজনের তা মেনে নিতে অসুবিধা হয়নি তো। কারণ আমরা আমাদের ধর্মকে আমাদের প্রাণের গভীরে প্রেমের আসনে পেতে ছিলাম। আমার দারিদ্র্য ছিল, অভাব ছিল। কিন্তু ক্ষোভ ছিল না, অভিযোগ ছিল না। বাইরের অভাব, বাইরের পার্থক্য অন্তরের সাধনায়, ভক্তিতে, আশ্বাসে, ভালোবাসায় পূর্ণ করে তুলেছিল আমায়। সেদিন আমার ঈশ্বর আমার ব্যক্তিগত ছিল। আমার ডাকে সাড়া দিত। আমার কান্না শুনত। আমার বিপদে আপদে আমি আকুল হয়ে তার পায়ের কাছে নিজেকে উজাড় করে দিতাম। আমার সে ভিন্ন বিশ্বাসী প্রতিবেশী আমার বিপদে তার ঈশ্বরের কাছে আমার হয়ে প্রার্থনা করত। যদি বলি দোয়া করত তবে কি আবেগের পরিবর্তন হয় গো? একই থাকে। কান্নার আওয়াজ যার গলায় যেমন হোক, যে ভাষায় হোক, যন্ত্রণা কি আলাদা হয়? আমাদের দুজনেরই তাতে অসুবিধা হয়নি তো কোনোদিন। অসুবিধা হতে শুরু করল যেদিন তোমরা এলে।
        আসলে যে মানুষ তার ধর্ম বিশ্বাসে, ঐকান্তিক সাধনায় নিজের অন্তরে পরিপূর্ণতা পায়নি সেই বাইরে অমন অশান্ত, একচোখো, বিদ্বেষকামী হয়ে থাকে। তোমার যাতে রুচি, তোমার যাতে তৃপ্তি তুমি সেখানেই শান্ত হও। আমার তৃপ্তি আমার রুচিতে আমি শান্ত, তৃপ্ত। তোমার এতে অসুবিধা কোথায়?
        আসলে তোমাদের মতলব স্বার্থ। আমাদের কোনো মতলব ছিল না। আমাদের জীবনের থেকে একটু শান্তি আর সুখের বেশি কিছু চাহিদা ছিল না। তাই কোথায় কতখানি ফারাক দেখে দেখে বেড়ানো আমাদের কাজ ছিল না। তোমাদের উদ্দেশ্য ক্ষমতা। আমাদের উদ্দেশ্য শান্তি। তোমরা তাই ব্যবহার করতে চাও আমাদের। তোমরা তাই আমাদের দারিদ্র্যের গর্তে গরম তুষ ভরে ভরে দাও। আগুন জ্বালাও। সে আগুনে নিজের অহংকে সেঁকে নিতে চাও। এতেই তোমার ক্ষমতালোভী ক্ষুধার ক্ষণিক আরাম। আমার ঈশ্বর আজ আমার ঘরের কোণা ছেড়ে বারোয়ারি হয়েছে তোমাদের জন্য। আমার প্রার্থনা আজ স্লোগান হয়েছে তোমাদের জন্য। আমার কান্নার পবিত্র জল হারিয়ে গিয়ে তপ্ত লাভা হয়েছে তোমাদের জন্য। আমার মনের কোণের শান্ত, স্থির বিশ্বাস, ভক্তি আজ উন্মাদনা হয়েছে তোমাদের জন্য। আমি কিছুতেই স্থির হতে পারছি না। আমার ঘরের ছেলে আজ তার হৃদয়মন্দিরের সিংহাসন শূন্য রেখে তোমাদের বানানো অপদেবতার ঘোরে পড়েছে। সে শান্তির কথা বলে না। সে কি ভাষায় কথা বলে আমি বুঝি না। আমি শুধু তার চোখের দিকে দেখি। সে চোখে শান্তি নেই, তৃপ্তি নেই। আমি মূর্খ হলেও এটুকু জানি যে, যে চোখে শান্তি নেই সে বুকে ঈশ্বর নেই। কোনো বিশ্বাসের ঈশ্বরই নেই, ক্ষুব্ধ হৃদয়ে থাকে না সে। আমায় ভুল বোঝতে পারবে না। আমি শান্তির সংজ্ঞা না দিতে পারি, ঈশ্বরকে চোখে না দেখে থাকতে পারি, কিন্তু সে অদেখা ঈশ্বরকে আন্তরিক ডাকার যে ফল, অসীম শান্তি, সে আমি জানি। তুমি ভণ্ড। তোমাদের হুঙ্কারে আমার বুক কাঁপে। সাথে আমার বুকের ভিতর যে শান্তিময় মন্দির, সে মন্দিরে যে দেবতা সেও কেঁপে ওঠে।
        তোমরা কারা আমি জানি না। আমি স্লোগান বুঝি না, আমি উন্মত্ততা বুঝি না, আমি আমার ঘরের কোণের শান্তি বুঝি। আমি আমার প্রাণের গভীরের সেই হারিয়ে যাওয়া আনন্দ খুঁজি। আমার একলা মুহূর্তে জাগা আমার নীরব শান্ত ঈশ্বরের চোখদুটো খুঁজি। দেখো সংসারে আমার অভাব, অপূর্ণতা, বঞ্চনা সব আছে। সে কার নেই বলো? জীবনে কে সব কিছু পায়? কিন্তু আমার প্রাণের আসন থেকে আমার আনন্দময় বিভুকে কেড়ে নিও না। তোমার চোখের মণিতে মতলবের কাজল, তাই তুমি সব কিছু এত ভেদাভেদের দৃষ্টিতে দেখো। একবার সে মতলব সরিয়ে ফেলো যদি দেখবে সব তার যথাস্থানেই আছে।
        মনের মধ্যে কালি থাকে। থাকে বলেই আত্মশুদ্ধির পথে হাঁটে মানুষ। কিন্তু তুমি তো সে কালি নিয়ে বাজারে ব্যবসা ফাঁদছ নিজের মতলব সিদ্ধ করতে। এতে বড় অমঙ্গল। বুঝছ না? এতে যে সার্বিক ক্ষতি, সারা সংসারে আগুন লাগালে যে তোমার ঘরটাও একদিন পুড়ে ছাই হবে। এটা কবে বুঝবে?