একটা রঙের জোয়ার এসেছে আমাদের দেশে। এতদিনের বিচ্ছিন্নতা আর পোষাচ্ছে না। একটা নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াবার নির্দেশ আসছে। যারা দাঁড়াতে পারছে না তাদের ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার নির্দেশও আছে সার্কুলারে। ধর্ম প্রাচীন না। ধর্মের একটা শক্তি আছে। ধর্মের ভূগোলে বিশ্বাস করা কিছু মানুষ বলছে এই সীমার মধ্যে নিজেকে বেঁধে ফেলো। তারপর ধর্মের সেই আদিম শক্তিটাকে ভাপিয়ে তোলো। পাতলা, মিহি দর্শন যা ধরতে গেলে পিছলে যায় সেই ধর্ম না। একটা মোটা কাতা দড়ির মত শক্ত কিছুর গায়ে দর্শনের প্রলেপ দাও। বোঝাও প্রাচীন ধ্রুব সত্যের মহিমা।
একটা বলিষ্ঠ গণতন্ত্র একটা সুক্ষ্ম রাজতন্ত্রের উপরেই দাঁড়ায়, এটা স্পষ্ট বুঝতে হবে। ভারত রাজনীতি বোঝে রাজার মহিমায়। আলোচনা, চর্চার থেকে শক্তিশালী শব্দ এখানে নির্দেশ দেওয়ার বলিষ্ঠ হাতের উপর আস্থা। আলোচনা বুঝতে আমরা দুর্বলতা বুঝি। সেন্টিমেন্টালিজ্ম আর প্যাট্রিয়াটিজ্মের সখ্যতা গভীর আমাদের মাটিতে। মহাপ্রভুর চৈতন্যদেবের ‘হা কৃষ্ণ’ কান্না আর দেশের মাতৃবন্দনায় কান্নার একই সুর আমাদের – প্যাট্রিওয়টিজ্মের সাথে ভক্তির রসায়ন আমরা ভালো খাই। রামপ্রসাদী সুরে দেশাত্মবোধ। দেশে আত্মবোধ না মানবতায় আত্মবোধ? না, প্রাচ্যে মানবতায় আত্মবোধ জন্মায়নি বাস্তব জীবনে কোনোদিন, শাস্ত্রে যাই থাক। আমাদের সব স্বীকৃতি পাশ্চাত্য অভিমুখী। আমাদের শিল্প, সাহিত্য, সিনেমা, অর্থনীতি ইত্যাদির চূড়ান্ত স্বীকৃতি পাশ্চাত্যে। আমরা তাদের মানদণ্ডে উতরে গেলেই সার্থক। বুকার, অস্কার, নোবেল, গ্র্যামি, পুলিৎজার ইত্যাদি যাই বলো। যদিও আমরা অনন্তের পুত্র-পুত্রী। ব্যস অত অবধিই। ওর বেশি আর এগোতে দিইনি আমরা নিজেদের। ওর পরে বিরাট খাই। নিজেকে বাস্তবের আঙিনায় বাজিয়ে নিতে আমরা বরাবর অপারগ। অন্যের দ্বারা সাধিত বাস্তবের আঙিনায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যে নির্যাসটুকু পড়ে থাকে তাকে হাতের চেটোয় তুলে নিয়ে যতটা সম্ভব ঘরে এনে জড়ো করতে আমাদের জুড়ি নেই।
আজ যে কন্ঠস্বরগুলো চেপে দেওয়া হচ্ছে এক এক করে সে কণ্ঠস্বরগুলোর প্রতিধ্বনি অন্যান্য কণ্ঠস্বরে এত দুর্বল যে তাতে লজ্জা জাগে। আমাদের ওতে কিছু আসে যায় না। আমরা জানি আমাদের কোনো দায় নেই। আমাদের কোনোদিনই কিছুর দায় ছিল কি? ছিল না। আমরা অন্যের দায়ের সুচারু সম্পন্নতার চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পেরেছি, কিন্তু নিজের দায়কে ভবিতব্যের হাতে ছেড়ে নিশ্চিন্তে বসে আছি। যে কোনো উচ্চ-আদর্শ বিলাসী জাতিই কপট হয়। আর সেই কপটতার ছিদ্র দিয়েই তাদের প্রাণশক্তি, আয়ু স্খলিত হতে থাকে, চুঁইয়ে চুঁইয়ে বেরিয়ে যেতে থাকে। আমরা সেই নিষ্ক্রিয় দুর্বল অবস্থাকে উন্নত চরিত্রের পরাকাষ্ঠা বানিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগি আর চারদিকের যত আধিব্যাধিতে ঘিরে থাকি।
একজন শাসকের সবচাইতে বড় ভয় সত্যে না, সত্যের প্রকাশে, যে সত্য তার দুর্বলতার বার্তা বহন করে। আর দুর্বলতার বার্তা বহনকারী মাধ্যমকে আমরা বলি সাংবাদিকতা। বিরোধীপক্ষ থাকে, তাকে নিয়েও ভয় নেই আমাদের। কারণ আমরা জানি, আমাদের দেশে যারা বিরোধীপক্ষ তারা আসলে পরাজিতপক্ষ। পরাজিতপক্ষ আর বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। যার পরিচয় শুধু পরাজয়ে তার সামনে একটাই লক্ষ্য জয়ী হওয়ার। আর বিরোধীপক্ষের একটা বড় দায় শাসককূলের স্বেচ্ছাচারিতার, অপসিদ্ধান্তের যুক্তিযুক্ত বিরোধিতা করা। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা বিজেতা আর পরাজিতর সংঘর্ষ দেখে আসছি কেবল, কোঁদল যত দেখি তর্ক তত দেখি না। আমাদের জঙ্গলে যেন সিংহ নেই, সিংহের ছাল আছে শুধু, যা বিদেশ থেকে আমদানি করা।
এরও একটা কারণ আছে যা আরো গভীরে। আমরা বিরোধিতা বলতে স্বার্থ আর আবেগের ঊর্দ্ধে উঠতে পারি না বলে আমাদের বিরোধী দলের সংখ্যা এত বেশি। বিরোধিতা করারও একটা নীতি আছে। তা হাত-পা ছুঁড়ে কান্না নয়, কাদা ছেটানো নয়, ষড়যন্ত্র নয়। তা প্রকাশ্য যুক্তির আলোয় রুখে দাঁড়ানো আর বাস্তবের নিরিখে তার প্রয়োগের সম্ভাব্যতা বিচারে তাকে ফলীয়মান করে তোলার সৎপ্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করা। তা তো আমাদের মাটিতে হওয়ার জো নেই। না পোষায় দল খুলুন। মঙ্গলের নীতি একটা হয় না, একত্বে হয়। সেই একত্ব জন্মায় একটা দেশের উন্নতির স্বার্থে একমুখী চর্চায়। একের স্বার্থ বিচ্ছিন্ন টুকরো টুকরো হয়, দশের স্বার্থ একটা নীতিতে চলে। আমার বাড়ির নর্দমা, রাম-শ্যাম-যদু-মধু'র বাড়ির নর্দমা যে বড় নর্দমায় এসে মেশে তাকে কি করে পরিবেশের ক্ষতি সাধন না করে পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া যায় তার জন্য একজোট হয়ে একটা ব্যবস্থা নিতে হয়। আমাদেরই নিতে হয়। কারোর উপর সে দায়িত্বটা দিয়ে তার ভাবনা অনুযায়ী একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হয়। আমাদের কপালে সে ‘কারোর’ খোঁজটা পাওয়া বড় দুষ্কর। কারণ আমরা আত্মস্বার্থে বিচ্ছিন্ন। নারীবাদী ভাবছে তার মত অনুযায়ী সমাজটা চললেই উন্নতি, সংরক্ষণবাদী ভাবছে তার, প্রাচীনবাদী, পুঁজিবাদী, সাম্যবাদী, ধর্মবাদী ইত্যাদি নানা বাদীতে বাদীতে ছয়লাপ, সেই স্বাভাবিক, কিন্তু এদের মিলিত কোনো কন্ঠ নেই। কারণ টুকরো টুকরো বিরোধিতাকে একটা বড় আকারে, সুনির্দিষ্ট নীতিতে দেখতে আমরা অক্ষম। ফলে যত স্বার্থ তত দল। ভাবের মিলনও হয় না, আর কাজের বেগও মঙ্গলমুখী হয় না। কারণ মিলনের ভাবমূর্তিটা আমাদের চিন্তায় কোনোদিনই ছিল না। তার মধ্যে এত ফাঁক-ফোঁকর বলেই যে না এতদিন ধরে এতগুলো বিদেশী শাসনের, শোষণের সাক্ষী আমাদের মাটি। নীতির বিরোধ হলে দুটো দলেই লড়াই চলে, স্বার্থের রূপ যেমন অজস্র তেমন আমাদের দেশে দলের সংখ্যাও অজস্র।
আজ ভাবনার দিন। দুশ্চিন্তার দিন। যে রঙে মাতামাতি হচ্ছে তা আদতে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। একের মধ্যে বহুত্বের নির্বাসনে না বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যে?