(আজ গুরুপূর্ণিমা। প্রজ্ঞা, জ্ঞান, বোধ, শুভবুদ্ধির দীপশিখা বহনকারী সেই পুরাকাল থেকে অধুনা সমস্ত আলোকিত আত্মার প্রতি আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।)
বিবেকানন্দের একটি বিখ্যাত উপমা - নিউটন আপেল মাটিতে পড়া দেখে মাধ্যাকর্ষণ সূত্রটি আবিষ্কার করলেন। তা বলে কি মাধ্যাকর্ষণ সূত্রটিও গাছের সাথে ঝুলছিল? না। সেটা নিউটনের নিজস্ব ভাবনাপ্রসূত। ভাবনার উৎস অবশ্যই ওই আপেল, যা নিউটনের মনকে আন্দোলিত করেছিল।
অভিজ্ঞতা আর বোধের মধ্যে তবে সম্পর্কটা ঠিক কোন গোত্রের? বোধ কি তবে অভিজ্ঞতা আর প্রজ্ঞার মিলিত সত্তা একটা? যার বহিঃপ্রকাশ হল চরিত্র? কিরকম একটু ভাবা যাক।
আমাদের জীবন অর্থে একটা নিরবচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতার ধারা। ঘুমের গভীরতাও আরেক ধরণের অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতাগুলোর একটা নির্যাস কেউ গ্রহণ করে আমার অন্তরের মধ্যে, ধীরে ধীরে একটা রূপ গড়ে ওঠে আমার। বাইরের আমি ততটা 'আমি' নই যতটা আমি ভিতরের 'আমি'। মানে আমার সাথে আমি। বাইরের 'আমি'টার প্রধান অংশ জুড়ে একটা অভিনয়। তাতে অনেক গোঁজামিল, অনেক ফাঁকি। সে আমিও জানি। কিন্তু ভিতরের ওটা কি বলা হল? আমার সাথে আমি? “তোমার ভিতর বসত করে কয় জনা মন, কয় জনা?”
আমার চেতনায় যে সত্য উদ্ভাসিত হয়, তাকে অনুধাবন করে কোন চেতনা? তার কি সংজ্ঞা হয়? রূপ হয়? হয় না তো। কিন্তু কথা হচ্ছে অত ভিতর মহলে কোনো ধুলোবালি ঢোকে না, যতটা থাকে বাইরের মহলগুলোতে। আর আমাদের চিন্তা-বলা-চলা সবই ওই বাইরের মহলের থেকেই। অত গভীরে ঢুকলে ছাই কাজ হয় নাকি? তবে? সেই বাইরের মহল নিয়েই কথা।
এও তো সত্যি যে, ভ্রান্তিও এক ধরণের অভিজ্ঞতা? ভ্রমের অবসানও আরেক ধরণের অভিজ্ঞতা? কিন্তু যে সময় আমি ভ্রান্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, সে সময়টাতে তো আমার ভ্রম ভাঙার অভিজ্ঞতা হচ্ছে না। যেমন স্বপ্নের অভিজ্ঞতা যখন হচ্ছে তখন তো আমি সেটাকে স্বপ্ন বলে জানছি না, তাকে তো সত্যি বলেই বোধ হচ্ছে। কারণ সব মিথ্যার বিশ্বাস উৎপাদনের হাতিয়ার তো ওই সত্যের মুখোস, সেকি আর জানতে বাকি আছে! এও তেমন। যখন আমার ভ্রান্তির অভিজ্ঞতা হচ্ছে, অর্থাৎ ভ্রান্তিকেই সত্য বলে বিশ্বাস করছি, অনুভব করছি, চিন্তা-বলা-চলাকে চালিত করছি সেই অনুযায়ী, যে যাই বলুক নিজের গোঁ'তে টিকে থাকার আত্মাভিমান পোষণ করছি মনে মনে, তখন কি বিন্দুমাত্রও আভাস পাচ্ছি যে, এ প্রাসাদ বালির উপর দাঁড়িয়ে? কিছু মুহূর্ত পরেই ধুলোয় চুরমার হয়ে ভেঙে পড়বে? না তো, জানছি না। তাই "না জানিয়া পথ ভ্রমিতেছি পথে, আপন গরবে, অসীম জগতে"।
এই তো হল অভিজ্ঞতার অবস্থা। সে ভ্রান্তি থেকে পরিত্রাণের কোনো আশা নেই। কোনো মানুষ কোনোদিন জোর দিয়ে বলতে পারবে না তার সমস্ত অভিজ্ঞতা সত্যসঞ্জাত। মূলেই যে সে কথা স্বীকার করা - 'যা দেবী সর্বভূতেষু ভ্রান্তিরূপেণসংস্থিতা / নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমোঃ'। তবে উপায়? নাস্তিক বলবে 'সময়', আস্তিক বলবে 'ঈশ্বরের কৃপা' - 'অসতো মা সদগময়... তমসো মা জ্যোতির্গময়... আবীরাবীর্ম এধিঃ'.. হে স্বপ্রকাশ তুমি আপনাকে প্রকাশ করো আপনি। এ আদিম প্রার্থনা। মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে এই প্রার্থনা উদগত হয়েছিল সেই প্রাচীন যুগে, ক্ষুদ্র 'আমি'র স্বার্থে নয়, বৃহৎ 'আমি'র স্বার্থে। যে আমিটা বাইবেলের মতে শুধু রুটিতে বাঁচে না। সে সত্যজ্ঞানপুষ্ট হতে চায়। তার জন্য সে নানান ত্যাগ স্বীকার করে, কৃচ্ছসাধন করে, এমনকি আত্মাহুতি পর্যন্ত দিতে প্রস্তত থাকে। শুনেছি 'হেলিকোব্যাকটর পাইলোরী' নামক জীবাণুর অস্তিত্বের আবিষ্কর্তা দুই বিজ্ঞানী, উক্ত জীবাণুতে যে সত্যিই পেটে ক্ষত সৃষ্টি হয় প্রমাণ করার জন্য নিজেরা সেই রোগে ইচ্ছাকৃতভাবে সংক্রামিত হয়ে প্রায় জীবন বিপন্ন করে প্রমাণ করেছিলেন। এ উদাহরণ বিজ্ঞানের জগতে বিরল নয় অবশ্য।
কিন্তু সে তো গেল জাগতিক জ্ঞানের জগতের কথা। মানুষের তো দুটো রাজ্যে বিচরণ, এক বাইরের আর এক ভিতরের। বাইরের রাজ্যে তো যুক্তি-প্রমাণ ইত্যাদির মাধ্যমে সুরাহা মেলে। ভিতরের জগতে? সেখানে যুক্তি কিছুদূর গিয়ে পথ হারায় আর প্রমাণ কার কাছে কে করবে? সব ঘেঁটে ঘ। সেখানেও ভ্রান্তির পর ভ্রান্তি। যে শরীর নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, সেটা গেলে কি আর চিন্তার অবকাশ থাকে? আর চিন্তা না করতে পারলে কি নিজের অস্তিত্বের কোনো পরিমাপক জ্ঞান সম্ভব? ঘুমের মধ্যে কি 'আমার আমি'কে টের পাই? পাই না তো। তবে? তবে সংজ্ঞা না থাকুক, বোধ থাকে একটা। মাপ না পাই, অস্তিত্বের আভাসটুকু ছেড়ে যায় না কখনও। যার উপর নির্ভর করে আবার জেগে উঠি। জাগরণের প্রাক্কালে আবার ক্ষণমাত্র শূন্যতার পরই বহির্বিশ্বে নিজের পরিমাপযুক্ত আমি জেগে ওঠে - অমুক আমি... তমুক পাড়ায়... অমুক দেশে... তমুক পরিবারে... তমুক দায়িত্ব... রাগ... বাসনা... পরিকল্পনা... ভয়... সব এসে এসে একটা গোটা 'কেজো আমি'কে আমার ভিতরের আমি'র উপর দাঁড় করায়।
কিন্তু যে প্রজ্ঞার কথা হচ্ছিল সে কে তবে? Intuition না Kant-এর pure reason সে? কে বলবে? একটা খুব পুরোনো উদাহরণ ভারতীয় কাব্যে দর্শনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শুদ্ধ বারিধারা যেমন করে মাটিতে মিশে লিপ্ত হয়, তেমন আমাদের বাসনামণ্ডিত ক্ষুদ্র 'আমি'তে জড়িয়ে চেতনা আস্পিষ্ট হয়। 'পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে'। উপায়?
যিনি এই অবস্থার মধ্যে আমার চেতনার আলোকে অহং-এর ছায়ামুক্ত করে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেন তাঁকেই বলা হল - গুরু, অর্থাৎ যিনি অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যান। আমায় ভ্রম থেকে মুক্ত করেন। তিনি কোনো মানুষের সংজ্ঞা নন। তিনি একটা অবস্থার কথা। বুদ্ধ যেমন বলেছিলেন, 'বুদ্ধত্ব' একটা নির্মোহ, ভ্রান্তিহীন অবস্থা। 'গুরু' যিনি বিকারমুক্ত। বিকার অর্থে complex নয়, distortion। যা পরিবর্তিত মূল অবস্থা থেকে। তাই বলা হয়, তেমন আকুলতা থাকলে শেষে মনই গুরু হয়। ঠিক তাই তো। আমি আমার ছাত্রকে যাই বোঝাই না কেন, তার ভিতরের শিক্ষক তাকে ভিতরে বসে না বোঝালে সে শুধু তথ্যমাত্র যা আত্মকৃত হয়নি। কি লাভ তাতে? রমণ মহর্ষি বলছেন, বাইরের গুরুর কাজ শুধু ভিতরের গুরুর কাছ অবধি পৌঁছে দেওয়া। সত্যিই তাই। যদি বলা হয়, সেরকম গুরু পাই কই? ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব বলছেন, সচ্চিদানন্দই গুরু। অর্থাৎ তোমার মধ্যের চেতনা-আনন্দ'র যে অস্তিত্ব তাকেই আরো গভীরভাবে চাও, ডাকো, আত্মসমর্পণ করো, সব মিলবে। "আপনাতে আপনি থেকো মন, যেও নাকো কারো ঘরে / যা চাবি তা বসে পাবি খোঁজো নিজ অন্তঃপুরে"... জয়গুরু।