চিন্তা করে কেউ পায় না। বিশ্বাস করেও না। পায় তাকিয়ে। খোলা চোখে তাকিয়ে। তাকায় না। ভয় পায়। যা দেখবে তার সঙ্গে তার ইচ্ছা মিলবে না। তাই তাকায় না। বেশিরভাগ মানুষই তাকায় না। তাকানোর ভান করে থাকে। তাই দেখে, যা ইচ্ছা করে দেখতে। কিন্তু তবু তাকাবে না।
একবার যদি চারদিকটা তাকিয়ে দেখত, তার ধর্ম, তার বিজ্ঞান, তার টাকাপয়সা, তার রাজা-মন্ত্রী, চিন্তাবিদ-বুদ্ধিজীবীরা কী কাণ্ড করে বসে আছে। একবার যদি তাকিয়ে দেখত মানুষ।
সত্য ভাবনার জিনিস না। তাকানোর জিনিস। আপেল মাটিতে পড়েছিল। নিউটন তাকিয়ে দেখেছিলেন। তারপর নিজের ভিতরে তাকিয়েছিলেন, ভাবার তত্ত্ব খাড়া করেননি। তাকিয়ে দেখেছিলেন নিজের যুক্তির দিকে। একের পর এককে রেখেছিলেন পাশাপাশি। কিন্তু যদি ভাবতেন, তবে হয় তো একটা গল্প ফাঁদতেন। পৃথিবীর মধ্যে এক বড় রাক্ষুসী আছে। সব কিছুকে সে নিজের পেটের মধ্যে টানছে।
আমাদের দেশে সব পাঁজি অনুযায়ী হয়। পুজো-আচ্চা, ভিতপুজো, অন্নপ্রাশন থেকে বিয়ে, এমনকি গর্ভাধান। পাঁজিতে সবের বিধান আছে। চাঁদের পৃথিবীকে আবর্তন আর পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে এই ছোট্টো ভুখণ্ডের উপর যে যে ঋতু-মাস যায়, সে সব অনুযায়ী পবিত্র-অপবিত্র, ঠিক-ভুল সবের হিসাব হয়ে যায় আমাদের। এইভাবেই আমাদের পূর্বপুরুষেরা নিজেদের খেয়ালের দাসত্ব করেছে, বাইরের জগতটাকে নিজের বুদ্ধির চোখে খোলা চোখে তাকিয়ে দেখেনি।
আমাদের বুদ্ধির খোলা চোখ আজও নেই। আজও লক্ষ লক্ষ ভারতীয় নরনারী সকাল ঘুম ভেঙে চোখ খুলে থেকে ঘুমাতে যাওয়া অবধি 'সংস্কার', 'ঐতিহ্য' মেনে চলে। যার উপর তার আর তার গত চোদ্দোগুষ্ঠি আর আসন্ন চোদ্দোগুষ্ঠির 'ভালো' নির্ভর করছে। আসলে আমাদের মজ্জাগত এসব। আমরা হাত পাততে ভালোবাসি। স্বনির্ভর হতে হবে, এ কথাটাও আমাদের দেশে স্লোগান হয়ে হাওয়ায় ভাসে। সেটাও আমাদের শেখাতে হয়। আমার কী কর্তব্য আছে সমাজের কাছে, দেশের কাছে বড় কথা নয়, প্রথম কথা নয়। আসল কথা আমি কী কী পেতে পারি? আমার ভাগ্যের কাছ থেকে, দেব-দেবীর কাছ থেকে, গ্রহ-নক্ষত্রের কাছ থেকে, পাথর-শিকড়বাকড়ের কাছ থেকে, পঞ্চায়েত কি মিউনিসিপালিটির মেম্বার থেকে প্রধানমন্ত্রী অবধি সবার থেকে কী পেতে পারি সেটাই আমার প্রধান বিবেচ্য। আমার কর্তব্য শুধু 'ভক্ত' হয়ে থাকা। আমার ওইটুকুই শুদ্ধভাবে করতে হবে। কার কখন কতটা ভক্ত হয়ে থাকলে আমার আখেরে লাভ হবে সেটাই আমার প্রধান ভাবনার জায়গা। এমনকি যারা বিজ্ঞানের ছাত্র, কি গবেষক, তাদেরও এই একই কৃষ্টিপন্থী ভাবধারা দেখে অবাক হতে হয়। যতক্ষণ বিজ্ঞানের ক্লাসে, কি পরীক্ষাগারে, ততক্ষণ প্রথাগত যুক্তির অনুসারী। যেই বাইরে, অমনি সমাজের নানা বিধিনিষেধ, নিয়মকানুন যা যুগান্তরের অন্ধবিশ্বাসে লালিত, তার কাছে নতিস্বীকার হয়ে গেল। কারণ ওতে আমার লাভ। আমার সুখের জীনের সুরক্ষা। আমার বিলাসের নিরাপত্তা।
তবু তাকাবে না। তবু নিজের বুদ্ধিটাকে স্বচ্ছ করে, স্পষ্ট করে তাকিয়ে দেখবে না কী হচ্ছে চারদিকে। সাধু থেকে নেতা, শিক্ষক থেকে বুদ্ধিজীবী কী সাংঘাতিক দ্বিচারিতায় ভরা, সে দেখবে না। সে শুধু ভক্ত হবে। ওইটাই আমার জীবনের লক্ষ্য। আমি যে কোনো প্রভাবশালীর ভক্ত হতে পারি, তুমি শুধু বলো যে সে টিকে থাকবে। আমার ওই একটাতেই ভয়। টিকবে তো? আমার তাই এত দেবদেবী, কে কখন কতদিন টিকে থাকবে কে বলতে পারে? আমার বিশ্বাস আমার স্বার্থবুদ্ধির সঙ্গে মিশে আমায় এমন বহুমুখী করে রেখেছে যে এক-একসময় আমি আমার নিজের মুখই চিনতে পারি না।
আজ সে রাস্তাতেই হাঁটছি, আর আমাদের এ স্বভাব আরো পাক্কা হচ্ছে। আমাদের রঙ আরো পাক্কা হচ্ছে। কেন আমরা ভক্ত হতে চাই? কেননা আমাদের যে করেই হোক শান্তি চাই। আমি জানি না আমাদের মত করে এত ভীষণ করে শান্তি আর কেউ চায় কিনা। যে কোনোভাবেই আমি এক জড়তায় পৌঁছে গেলে আমার শান্তি। যেখান থেকে আর সামনে এগোতে হয় না। এই জড়ত্বলাভকে আমরা শান্তিলাভ বলি। যে ভাবেই হোক আমি এই জড়ত্বলাভ করতেই চাই। বুদ্ধির জড়ত্ব।
জীবনের ধর্মই হল বাধাবিপত্তি কেটে সত্যের রাস্তা খোঁজা। তার মধ্যে অনেক ভুলভ্রান্তি। অনেক অপূর্ণতা। অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি। কিন্তু আমি একটা 'পবিত্র', 'পূর্ণ', শান্তিময় স্থিতি চাইছি। পড়ুন আমি একটা জড়ত্বের অবস্থা চাই। এমন এক জড়ত্ব অবস্থা যেখানে আমার বুদ্ধি পর্যন্ত এমন অবশ হবে যে সেও কোনো প্রশ্ন করা থেকে বিরত হবে। এ এক অদ্ভুত মানসিকতা। আর যুগান্তর ধরে আমরা এই 'সেটল্' হওয়ার রাস্তাই খুঁজে যাচ্ছি। একদিন 'রায়বাহাদুর' হয়ে, কোনো রকমে একটা অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা করে 'শান্তিময়' জীবন কাটানোর। আজও সেই প্রথা চলছে। আমাদের দেশের শতকরা প্রায় একশোভাগ ছেলেমেয়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে, কারণ ওতে ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত থাকে। চাকরি পেতে সুবিধা হয়। তাই আমাদের এখানে যত ছেলেমেয়ে বিজ্ঞান শাখায় পড়াশোনা করে, যত সংখ্যক ছেলেমেয়ে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি শাখার নানা পদে চাকরি করে, সে তুলনায় বিশ্বের দরবারে গবেষণায় আমাদের পদচিহ্ন কই? কারণ বিজ্ঞান আমার জীবিকার উপজীব্য, প্রাণের খাঁটি প্রশ্ন বা সাধনা তো না। আমাকে সত্য খুঁজতে হবে না, আমার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক মানপত্র পেলেই হবে। ওতে আমার সামাজিক জীবনকে একটা মর্যাদাময় স্থিতিতে এনে দিলেই সে শান্ত।
ওই যে বললাম, আমরা জানি না খোলা চোখে তাকাতে। যে মানুষ অতীতকে ধ্রুব, ত্রুটিহীন জেনে রাস্তায় নেমেছে, সে কেন খোলা চোখে সামনের দিকে তাকাবে? আমরা ধর্ম থেকে ধর্মান্তরে যাই। এক ডগমা থেকে আরেক ডগমায় যাই। কিন্তু গোটাগুটি সব ডগমা ছেড়ে সত্যিকারের প্রাণের ধর্মে কোনোদিন আমরা হাঁটব কিনা কে জানে? আজও আমরা পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানের সবটুকু রস শুষে তাদের খাঁটি সাধনা, তাদের সততাকে দূরে ফেলে 'সংস্কারি' সমাজের কথা ভাবছি। যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে খোলা চোখে তাকিয়ে দেখতে চাইছি না, বুঝতে চাইছি না যে, গোটা বিশ্বে মানুষের জাত একটাই। সে হাজার হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে রূপে, আকারে, আকৃতিতে, সংস্কৃতিতে আলাদা আলাদা হলেও মূলে আদতে এক। কেউ কোনো কিছু ধ্রুব, ত্রুটিহীন আবিস্কার করিনি। বুদ্ধির জড়ত্বকে যদি আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য করে তুলি, তবে যে লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, গ্লানির মধ্যে দিয়ে যাব, তাতে আমার কোনো গৌরব নেই। কিন্তু তাতে আমার কি? আমার না তাকিয়ে দেখলেই হল খোলা চোখে।