সব সিদ্ধান্তেই সংশয়ের জন্য একটা আসন রাখা খুব জরুরি। যার সংশয় নেই, তার রাস্তা নেই, জানলা নেই, দরজা নেই। বিশ্বাস স্থবির করে। সংশয় সচল করে।
ফরাসী বিপ্লব যখন ঘটেছিল তার আগে সে দেশে দুটো প্রধান স্তম্ভ ছিল রাজা আর ধর্মগুরুর। এদের উপর সাধারণ মানুষের প্রশ্নহীন আস্থা আর আনুগত্য ছিল। রাজা আর ধর্মগুরু নির্ভুল হবে, মঙ্গলময় হবে এমনই একটা ধারণা নিয়ে সে দেশ চলছিল। বিশ্বাসে স্থবির। অন্ধ।
বলা হয় মেয়েরা নাকি ভীষণ সরল বিশ্বাসী। কিন্তু ফরাসী বিপ্লবে ভিত ধরে নাড়াবার প্রথম কাজটা করে মেয়েরাই। মিছিল করে গিয়ে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে এসেছিল মসনদ। চমকে দিয়েছিল শুধু ষোড়শ লুইকে নয়, গোটা ইউরোপকে।
সেদিনের বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। ভলতায়ার, রুশো, দেকার্ত প্রমুখেরা মানুষের মধ্যে সংশয় জাগাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এজ অব এনলাইটেনমেন্ট, এজ অব রিজ্ন ইত্যাদি যাই বলি না কেন, আসলে সে যুগ ছিল সংশয়কে জাগানোর যুগ। সেই সংশয় জেগেছিল বলেই ফরাসী বিপ্লব হয়েছিল, গোটা বিশ্বের ইতিহাস বদলেছিল।
সত্য কী, এটা জানি না, এটাকে স্বীকার করাই একটা বড় সত্য। সত্যটাকে না জেনে তার জায়গায় কল্পনা নির্ভর একটা ধারণাকে মেনে নিতে না চাওয়াই সংশয়বাদীর একটা বড় দায়। একদিন যখন পক্স রোগের কারণ আমরা পাচ্ছিলাম না, তখন মা শীতলাকে কারণ হিসাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলাম। রবীন্দ্রনাথ বললেন, তাই আমাদের দেশে পক্স আর মা শীতলা দুই-ই থেকে গেল। ওদেশে ওরা রোগের কারণ খুঁজল, ত্রাণের উপায় খুঁজল।
সংশয়ী মানে দুর্বল না। সবল বুদ্ধি যার, সে-ই সংশয়ী হতে পারে। কারণ সে একটা জিনিসকে অনেকগুলো দিক থেকে দেখতে পারে। সিনিক বা অসূয়াপর হয়ে গেলে সে আলাদা কথা, কিন্তু সংশয়ই চিরকাল মানুষকে রক্ষা করে এসেছে, অন্ধবিশ্বাস নয়, এর সাক্ষী ইতিহাস।
প্রশ্ন উঠতে পারে, সব বিশ্বাসই তো অন্ধ, তবে? অবশ্যই বিশ্বাস অন্ধ। যেমন আমি বিশ্বাস করলাম যে, শিয়ালদা থেকে ট্রেনে উঠলাম এটা আমাকে হালিশহরে নিয়ে যাবে। এত অবধি আমার বিশ্বাস খাঁটি। কিন্তু যখন দেখছি একটার পর একটা স্টেশান আসছে যা হালিশহর অভিমুখী নয়, তখনও যদি আমি আমার বিশ্বাসকে ধরে বসে থাকি, তবে সে আমাকে ভুল জায়গায় নিয়ে যাবেই। একেই অন্ধবিশ্বাস বলে। নইলে মানুষকে একটা না একটা বিশ্বাসের জায়গা থেকে তো শুরু করতেই হয়। এ বাস্তব। কিন্তু সেই বিশ্বাসপ্রণোদিত যাত্রাটাকে মনিটরিং করতে করতে নিয়ে যায় সংশয়। সেটা না থাকলে সব ভেজাল।
ধরা যাক একটা ওষুধ কোম্পানির কথা। সেখানে অটোমেটেড যন্ত্রে ওষুধ বানানো হচ্ছে। এখন সেই যন্ত্রের উপর একদম প্রশ্নহীন আনুগত্য রেখে যদি কর্মচারী বসে থাকে তবে যে কোনোদিন ভুল ওষুধ তৈরি হতে শুরু হবে। তাই কোয়ালিটি কন্ট্রোলের ব্যবস্থা রাখা। তার কাজটা শুরুই হয় যন্ত্রের নির্ভুলতায়, বা Inerrancy বা Infallibility-র উপর সংশয় জাগিয়ে। সেই যন্ত্রের নির্মাতা কোম্পানি যতই গুণগান গেয়ে যাক, কোয়ালিটি কন্ট্রোলারের কাজটাই হল তবু তাকে সংশয় করা।
প্রশ্নহীন আনুগত্য বিষ। শ্রদ্ধা আর সম্মান যখন গুণের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে চলে তখন সে একটা ভালো জিনিস। কিন্তু যখন সে গুণদোষ বিচার না করে আপনিই ঝাণ্ডা উঁচিয়ে ঘোরে তখন সে গুণ্ডামি। শ্রদ্ধা-সম্মান বড় উঁচুদরের জিনিস। কিন্তু তার ভেক ধরে অনেক গুণ্ডামি সমাজের অলিতে-গলিতে হয়ে চলেছে। সেটা কাজের নয়।
সিদ্ধান্তের ঘরে তাই সংশয়ের আসন থাকা চাই-ই চাই। এই যে দেশের নির্বাচনের সময় চলছে, এখনও এই সংশয়ই আমাদের পথপ্রদর্শক। আমাদের এদিকে রাশিয়া, চীন, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়ায় যে ধরণের 'গণতন্ত্র' চলছে তেমন আনুগত্যপরায়ণ গণতন্ত্র চাই, না সঠিক অর্থে গণতন্ত্র চাই সেটা ভেবে দেখার। আমরা যারা সাধারণ মানুষ তাদের কাছে সবাই প্রশ্নহীন আনুগত্য দাবী করে। সে মাজনের ব্র্যাণ্ড থেকে সরকার অবধি। সবাই দাবী করে তাদের মত শুভাকাঙ্ক্ষী কেউ আমাদের নেই। সে দেওয়াল ফুঁড়ে মাজনে নুন আছে কিনা জিজ্ঞাসা করতে আসুক, কি কে শত্রু আর কে মিত্র ট্যাগ করে করে চিনিয়ে দেওয়ার কৌশল হোক। আমরা যেন কোনো ব্র্যাণ্ডের না হই। আমরা যেন কোনোভাবেই না তো কোনো প্রোপাগাণ্ডিস্ট হই, না তো কোনো প্রোপাগাণ্ডার শিকার হই। আমরা সবসময় সংশয়ী যেন হই। ওটাই আমাদের রক্ষার একমাত্র মন্ত্র।
তবে যে কথায় আছে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর?
কথাটায় ওই 'বস্তু'টি কী আসলে? ওটা হল নির্ঝঞ্ঝাট অজ্ঞতার স্বর্গ। তাই হাতের কাছেই সে মেলে। কিন্তু তর্কে বহুদূর বলেছে। পাব কি পাব না সেটা বড় কথা না, বড় কথা হল বহুদূর যেতে হবে সেই নিয়ে ভয় দেখিয়ে আতঙ্কিত করার কৌশলটি। আসলে এটা অলসদের মন্ত্র। যারা দূরে যাওয়ার ভয়ে চোখ বন্ধ করে 'বস্তু মিলেছে' বিশ্বাস করবে আর করাতে চাইবে। কিন্তু কোনো কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হবে না। হতে দেবেও না। "জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই" বলে দেবে। তখন চাঁদ গম্য হয়ে উঠবে, হয় তো বা মণিপুর অগম্য হবে।
আমাদের ভাবায় সংশয়। আমাদের চালায় সংশয়। আমাদের জন্য নতুনের বার্তা আনে সংশয়। এর বাইরে যা আছে সে ডিজনিল্যাণ্ড, লা লা ল্যাণ্ড। এখন প্রশ্ন আমাকে, আমি কোন রাস্তাটা বেছে নেব।