মহানামব্রত ব্রহ্মচারী বলতেন, রিলিজিয়ন ইজ ফর জেন্টলম্যান। এ কথাটা ওঁর বক্তৃতায়, ভাষণে, লেখায় বারবার ঘুরে ফিরে আসত। রিলিজিয়ন ইজ ফর জেন্টলম্যান। বলতেন আগে ভদ্র হও, মার্জিত হও, সুসংস্কৃত হও, তারপর এসো ধর্মে। তবে ধর্মের মর্ম বুঝতে পারবে।
এখন এই জেন্টলম্যান তৈরি করতে কি ধর্মীয় শিক্ষা লাগে? লাগে না। সুশিক্ষার সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। ঘৃণার বিপরীত শব্দ ভালোবাসা নয়, ঘৃণার বিপরীত শব্দ বোঝা। বুঝতে চাওয়া। তবেই মানসিক বিকাশ সম্ভব।
মানসিক বিকাশ কোনো দেশের জাতীয় সম্পদ নয়। মানসিক বিকাশ সমগ্র মানবজাতির সম্পদ। বেদব্যাস, শঙ্করাচার্য, রামানুজ, বুদ্ধ, মহাবীর, চৈতন্য, কবীর, নানক, মীরা, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, অরবিন্দ, রামকৃষ্ণ, গান্ধী, রমণ মহর্ষি প্রমুখেরা কোনো একটা জাতির সম্পদ নন। যেমন খ্রীস্ট, মুহম্মদ, রুমি, কনফুসিয়াস, জরাথ্রুষ্ট্র, সেন্ট অগাস্টিন, সেন্ট লরেন্স, মার্টিন লুথার, মাদার টেরেসা প্রমুখেরাও কোনো একটা দেশের সম্পদ নন। এনারা মানব সম্পদ।
পৃথিবীতে এমন কোনো ধর্ম নেই যে ধর্ম থেকে কোনো না কোনো মহাত্মা জন্মেছেন। বিবেকানন্দ বারবার এ কথা বলতেন। যে প্রবল ক্ষমতা নিয়ে আধুনিক সময়ে বিবেকানন্দ ভারতের মাটিতে এসেছিলেন, যে ভীষণ শক্তি ও প্রভাব সেদিন ভারতের মাটিতে ওঁর ছিল চাইলে সেদিনই এ দেশ একটি বিশেষ ধর্মের দেশে পরিণত হতে পারত। কিন্তু তা হয় নি। কারণ তিনি ভারতের আত্মার যে ভাষা সেই ভাষাকে বলার জন্য দায়বদ্ধ ছিলেন। সারাটা জীবন সহিষ্ণুতা আর গ্রহণযোগ্যতার বাইরে কোনো কথা তিনি উচ্চারণ করেননি। কারণ অবশ্যই তাঁর গুরু রামকৃষ্ণদেব।
সারা পৃথিবীর ধর্মের ইতিহাসে যা হয়নি, সেদিন বাংলার মাটিতে তা হয়েছিল। যেদিন গদাধর চট্টোপাধ্যায় থেকে একজন রামকৃষ্ণ হয়ে উঠছিলেন। যিনি শুধু নিজের জন্মলব্ধ ধর্ম নয়, অন্য ধর্মকেও সত্য অনুভব করলেন। শুধু অনুভব করলেন না, বললেন, সব ধর্মেই বালিতে চিনিতে মেশানো আছে। বালিটুকু ফেলে চিনিটুকু নিতে হয়।
সমস্যা হল যারা এই বালিচিনির পার্থক্যটা না বোঝেন। বালিকেও চিনির মূল্যে চালাতে চান। তা কি হয়? বালিচিনি পৃথক করার কৌশল কি তবে? ওই যে বললাম, মহানামব্রতজীর কথা, রিলিজিয়ন ইজ ফর জেন্টলম্যান। উইল ডুরান্ট লিখছেন যে তোমরা এতদিন একটা দেশকে এত এত অত্যাচারের মধ্যে রেখেও, বন্দুকের নলের সামনে রেখেও রামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীর মত মানুষ জন্মাতে আটকাতে পারলে না। অতএব হার স্বীকার করো, আর যত তাড়াতাড়ি পারো এ দেশ ছাড়ো।
অহিংসা আর শান্তি যে কোনো ধর্মের মূল কথা। সে যুক্তির কথা, সে তথাকথিত 'প্র্যাক্টিকাল' কথা নয়, সে নিতান্ত মানবীয় আদর্শ। সে পশুর আদর্শ নয়। রাজনীতির তুরুপের তাস নয়। সে জ্বলন্ত আদর্শ। খ্রীষ্টের শৈলপোদেশ কোনো বিশেষ ভৌগলিক অঞ্চলের মানুষের জন্য না, সে মানবিক সম্পদ। ঠিক একই ভাবে নানকের জপজী, রুমির কবিতা, বুদ্ধের ধম্মপদ ইত্যাদি সবটাই যেমন আমার। যেখানেই অহিংসা আর শান্তির কথা, সেই সমগ্র মানবজাতির উত্তরণের কথা। আজ পুলিশ দিয়ে, প্রশাসন দিয়ে যে শান্তি যেখানে যেখানে রাখা হচ্ছে সে শুধুমাত্র সাময়িক পরিস্থিতিকে সামাল দিয়ে রাখার জন্যেই। সে রাস্তা নয়, সে ঠেকনা। ঠেকনায় বাড়ি দাঁড়ায় না, বাড়ি দাঁড়ায় ভিতের উপর। ভিত হল অহিংসা আর শান্তি।
যেখানে যেখানে অহিংসার শিক্ষা নেই, সেখানে সেখানেই মানবজাতি বিপদের মুখে। রামকৃষ্ণদেবের শিক্ষাধারার এক বর্তমান যুগের সন্ন্যাসীর সঙ্গে এক ঘরে বসে সময় কাটানোর সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তাঁকে গুরুদেবের আসনে বসিয়েছিলাম সেদিন। আমি আগেও লিখেছি তাঁর কথা, তিনি সেদিন বন্ধ ঘরে বসে বলেছিলেন যে, "যেখানে যেখানে যেভাবে ঈশ্বর পূজিত হচ্ছেন, জানবে এক সত্যই পূজিত হচ্ছেন। তুমি রামকৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষিত হচ্ছে মানে সব ধর্মকে আজ থেকে সমান দৃষ্টিতে দেখা তোমার ধর্ম। এক এক ধর্মের উপাসনার ধারা এক একরকম, যেমন ঠাকুর বলতেন, মা মাছ এনেছে, কিন্তু এক এক সন্তানের জন্য এক এক রকমের রান্না করছেন, কারোর জন্য ঝোল, কারোর জন্য ঝাল, কারোর জন্য কালিয়া। যার পেটে যা সয়। তাই কারোর ধর্মের নিন্দা করতে নেই।"
এই বলে সেদিন শ্রদ্ধেয় আত্মস্থানন্দজী বলেছিলেন, "তোমার মসজিদ, গুরুদোয়ারা, চার্চ কোথাও যেতে বাধা নেই। মনে রেখো ঠাকুর কোনো সঙ্কীর্ণ আদর্শ শেখাতে আসেননি। যদি হৃদয় সঙ্কীর্ণ হচ্ছে দেখো, তবে জেনো তুমি ভুল রাস্তায় যাচ্ছো।"
ধর্মের মতামত, থিওলজি যাই হোক না কেন, আমি আজ অবধি কোনো ধর্মকে হিংসা, মিথ্যা ও নিষ্ঠুরতার পক্ষে কথা বলতে শুনিনি। আমি যে শিক্ষার কথা একটু আগে বললাম, সে শিক্ষা তো একটা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বসেই শুনলাম। তবে কেন কোনো ধর্মীয় শিক্ষালয় হিংসা আর বিদ্বেষের শিক্ষা দেওয়ার স্পর্ধা রাখবে। সে-ই সবার আগে বন্ধ হওয়া উচিৎ।
রবীন্দ্রনাথ যেদিন লিখেছিলেন, কবিতায়…. আজি দুর্দিনে ফিরানু তাদের ব্যর্থ নমস্কারে… সেই তার শেষ কথা ছিল না, পরে তিনিই বদলে নিয়েছিলেন তার শেষ প্রবন্ধে, সভ্যতার সংকটে, কিন্তু তবু মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ, এ কথা বলে।
ব্যাধগীতায় আছে, অহিংসা পরমোধর্ম, স চ সত্যে প্রতিষ্ঠিতাহ… অহিংসাই পরমধর্ম যা সত্যে প্রতিষ্ঠিত। কোন সত্যে প্রতিষ্ঠিত? তৈতেরীয় উপনিষদে আছে, সত্যম জ্ঞানম অনন্তম ব্রহ্ম। সেই সত্য, যা জ্ঞান ও অনন্তের অভিমুখী।
আর রইল মূর্তিপুজো নিয়ে কথা। সেদিন রামকৃষ্ণদেবের সময়েও ব্রাহ্মধর্মপন্থীদের মধ্যে এ সংশয় এসেছিল। কিন্তু মূর্তিপূজার মধ্যে দিয়েও যদি রামকৃষ্ণদেব, রামপ্রসাদ, চৈতন্যদেব প্রমুখ উদার হৃদয়ের উদাহরণ জন্মে থাকে, তবে বোঝাই যায় সমস্যাটা দেখায় না, দেখতে চাওয়ায়।
অহিংসা আর সহমর্মিতাকে আদর্শ করেই মানবাধিকারের সত্য উঠে এসেছে আজ আধুনিক সভ্যতায়। সেদিকে আমরা এখনই যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছি তা বলছি না, তবে রাস্তা সেদিকে না ঘোরালে আর কোনো উপায় নেই এও সত্য। যে মানুষ সাগরে বেড়াতে যাবে সে যেমন সমুদ্রস্নানের সরঞ্জাম জোগাড় করে, যে মানুষ পাহাড়ে বেড়াতে যাবে সে যেমন শীতের পোশাক জোগাড় করে, তেমনই যে মানুষ অহিংসা আর সহমর্মিতাকে আদর্শ করবে তার বর্তমানও সে আদর্শের অনুকূলেই বড় হবে। অহিংসার রাস্তা ছাড়া যে রাস্তা নেই সে কথা বলতে গিয়ে মার্টিন লুথার কিং মহাত্মাকে উল্লেখ করে বলেছিলেন, we may ignore him at our own risk.
এ কথা উপেক্ষা করার মাশুল আজ গোটা বিশ্ব দিচ্ছে। যে কোনো ধরণের হিংসাকে উৎসাহিত করা মানেই ভবিষ্যতের হিংসার বীজ ছড়ানো। ভারতবর্ষ হারিয়ে গেলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিন্তার বীজগুলো সব হারিয়ে যাবে - এ কথার প্রতিধ্বনি বহু পাশ্চাত্য মনীষীর কথায় বারবার ধ্বনিত হয়েছে। সে কোন ভারতের কথা? যে ভারত সগৌরবে ঘোষণা করে - সমস্ত জগত এক নীড়ের মত, বসুধৈবকুটুম্বকম।
প্রতিপক্ষ যতই নিষ্ঠুর, বর্বর হোক না কেন, অবশেষে যদি প্রশাসনের উপরেই নির্ভর করে ধর্মকে বেঁচে থাকতে হয়, সে ধর্মের জোরের জায়গাটা কোথায়? আর যে ধর্মের নামের সঙ্গে 'ফোবিয়া' উপাধি বিশ্বজুড়ে প্রচলিত হচ্ছে আজ, সে ধর্মের সঙ্গে শান্তি আর কল্যাণের যোগই বা কোথায়?
বার্ট্রান্ড রাসেল আগামী প্রজন্মকে ফ্যাক্ট আর টলারেন্স - এই দুটো রত্ন দিয়ে গেছেন নিজের সারাজীবনের মননজাত সম্পদের সার জেনে। রামকৃষ্ণদেব তাকেই আরো স্পষ্ট করে বলেছেন, উপনিষদের সত্যকে নতুন করে আবার, মত মানে পথ। নানা পথ যেমন একই গন্তব্যের দিকে থাকে, তেমনই নানা মত থাকবেই। এ ফ্যাক্ট। আর এই ফ্যাক্টের অন্তর্গত সত্যকে অনুভব করলে দেখবে, জল, অ্যাকুয়া, পানি আর ওয়াটার মানে একই কথা। তখন দ্বেষহীনতা আপনিই আসবে। শুধু পাণ্ডিত্যে কিচ্ছু হবে না। যদি বিবেক না জাগে। বিবেক মানে সত্যের খোঁজ। আর বৈরাগ্য মানে অসত্যে অনাসক্তি।
পৃথিবী জুড়ে শান্তি নামুক, এই প্রার্থনা। শান্তি, শান্তি, শান্তি।