Skip to main content

মনে হয় মৃত্যু সবচেয়ে বেশী সার্বজনীন। সকাল বেলায় নিজের কাজে ধরাবাঁধা ছকে ব্যস্ত, এমন সময় একজন খবর দিল পাশের পাড়ার একজন মিস্ত্রী মই থেকে পড়ে মারা গেছেন। কয়েকদিন হাসপাতালে ভর্তিও ছিলেন নাকি। তার একটু পরেই খবর পেলাম কলকাতার খুব নামকরা একজন চিকিৎসকের বাচ্চা ছেলেটা ICU তে জীবন মরণের স্পর্শরেখায় লড়ছে।
      আমি দুজনকেই চিনি না। না তো সেই মিস্ত্রীকে না তো সেই বাচ্চাটাকে। তবু মনটা হঠাৎ করে পুঁথির মত ছড়িয়ে পড়ল। কোনটা কোনদিকে গেল তার হদিশ পেলাম না। শুধু দেখলাম আমি এই আটপৌরে সংসারটাকে সামনে রেখে দূরে এসে বসে পড়েছি। আমার সামনে গাছপালা, পরিচিত অপরিচিত মানুষজন, পশুপাখী কলরব করতে করতে এগিয়ে চলেছে। আমি দ্রষ্টা। অথচ খানিক আগেই আমিও একটা নির্দিষ্ট ভূমিকায় এই প্রবহমান সংসারের মধ্যে ছিলাম, আশপাশ ভুলে। নিজের মধ্যে চিরকালের আমিটাকে ভুলে।
      কি করে হয়? এই মুহুর্তে যে আমি সারাটা সংসারকে এক নিবিড় স্নেহে মমতায় উপলব্ধি করছি, অপরিচিতকেও কোনো এক অকৃত্রিম আবেগে পরিচিতের মতই লাগছে, এ মনটা কোথায় থাকে? কাজের যে মন সে তো এভাবে দেখে না! সে তো একে বন্ধু, ওকে শত্রু, এটা দরকারী, ওটা তুচ্ছ এরকম হাজার একটা বিভাগ টেনে, নিজে কর্তা হয়ে বসে থাকে। ক্ষণে ক্ষণে তার রাগ, তার ক্ষোভ, তার ভয়, তার অভিমান, তার সুখ। শুধু তাই না, তার সকাল বিকাল, এ মাস সে মাস, এ বছর সে বছরে কত পার্থক্য।
     অথচ এখন! এই মুহুর্তে, কোনো বিভাগ নেই, কোনো পার্থক্য নেই, কোনো ক্ষোভ দুঃখ অভিমান হতাশা নেই। সে উদাসীন কিন্তু দুঃখী না। সে কিছু চায় না কিন্তু পেলেও তার কোনো ক্ষোভ বা লোভ নেই তার প্রাপ্ত বস্তুর ওপর। সে আত্মমগ্ন হয়ে বিশ্বমগ্ন। সে নিজের মধ্যে ডুবে গিয়ে এক অনন্ত সাম্যতা অনুভব করছে। তা যেন যুগ যুগ ধরে সারা বিশ্বকে ঘিরে অনন্তকাল ধরে পালন করে চলেছে। সেই সমত্বের অনুভুতিতে তার ভয় নেই এখন। কারণ ভয় তো অসমানে, বিরুদ্ধতায়।
      কেজো সংসারে যেন সে বৃত্যের একটা চাপে বাস করছিল। সেই ক্ষুদ্র অংশটাকেই সে সর্বস্ব জেনে তাকে আপ্রাণ সোজা করার চেষ্টায় ছিল। ব্যর্থ হয়েছে বারাবার। নিজেকে দূষেছে, নিজের ভাগ্যকে দূষেছে, আশেপাশের মানুষজনকে দূষেছে। এখন সে কেন্দ্রে। সে বুঝেছে তার বোঝার বাইরে একটা সামঞ্জস্যতা আছে, যাকে অতিক্রম করা যায় না।
     কিন্তু তার নিজের সাথে, সমগ্র বিশ্বের সাথে এ পরিচিয় ঘটালে কে? মৃত্যু। মৃত্যুকে তাই বলছিলাম সত্যিকারের সার্বজনীন। কারণ সে শূন্যের দিকের দ্বার খোলে। যা কিছু 'আছে' র দিকে, তা জীবনকে পুঁজি করেই। সুখ দুঃখ, বন্ধু শত্রু, আশা নিরাশা সব। আর মৃত্যুর সব 'নেই' এর দিকে। এই শূন্যতা মানুষকে দুর্বল করে? না করে না। সাময়িক ভাবে তা মনে হলেও কোনো সত্য মানুষকে কোনোদিন দুর্বল করে না, করতে পারে না। সেটাই সত্যের মহত্ব। তা তিক্ত হলেও বলপ্রদ।
      নিজেকে হারিয়ে নিজের এই স্বরুপটাকে যদি উপলব্ধি না করতে পারলাম তা একজন সফল মানুষ হয়েই হয় তো জীবনটা কাটাতে হত, সার্থক হত না। সবশেষে তাঁকেই স্মরণ করি যাঁর হাতধরে এতটা হেঁটে আসলাম, আশা রাখি বাকিটাও উতরেই যাব।

কেন রে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়?
জয় অজানার জয়।
এই দিকে তোর ভরসা যত, ওই দিকে তোর ভয়!
জয় অজানার জয় ॥

জানাশোনার বাসা বেঁধে কাটল তো দিন হেসে কেঁদে,
এই কোণেতেই আনাগোনা নয় কিছুতেই নয়।