শাসকদল আর বিরোধীদল। যা কিছু হোক, আলোচনাটা এর বেশি এগোতে শোনা আর আমাদের ভাগ্যে জুটছে না। টিভিতে, কাগজে, পত্রিকায়, রাস্তায় ঘাটে - একই বিষয়, শাসকদল আর বিরোধীদল। বার্ট্রান্ড রাসেলের একটা বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে - আমরা ভোট দিয়ে কাউকে একটা মন্ত্রীত্বে বসাই কারণ সব কিছুর জন্য কাউকে তো একটা দায়ী করতে হবে। আমাদের আলোচনাকেও তাই ওর বেশি এগোতে দিতে ভয় পাই। কি জানি বাইরের অন্ধকার যদি ঘরের অন্ধকারের দিকে আঙুল তোলে?!
একটা কথা। রাজনীতিতে মানুষ করে, না মানুষে রাজনীতি করে? যে সমাজে আমাদের জন্ম-কর্ম-মৃত্যু, আমাদের রাজনীতি কি সেই সমাজের বহির্ভূত কোনো বস্তু? তা তো নয়। তবে আমাদের জাতীয় সামাজিক মেরুদন্ডটা কি এতটাই মজবুত, ঋজু যে সেখান থেকে উঠে আসা রাজনীতির মানুষগুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের হবে? তা হতে পারে না। তবে এত বিস্ময় কিসের? পদের? না সেই চিরকেলে নিয়ম, চালুনি বলে সূঁচ তোর ইয়েতে কেন ফুঁটো?
আমার বারবার মনে হয়, কোনো জাতির চারিত্রিক রূপ বোঝার জন্য তার লাইনে দাঁড়াবার মানসিকতাটা একটা উন্নত নির্ধারক। গণতন্ত্রের একটা অভিনব পদ্ধতি লাইন করে দাঁড়ানো বা সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়ানো।
ব্যাঙ্কে, রেলে, গ্যাস অফিসে, হাসপাতালে ইত্যাদি সর্বত্রই এই ব্যবস্থা। গণতন্ত্রে সবার সমান অধিকার। তাই লাইনের আগে - মাঝে - পিছনের অবস্থানগত পার্থক্য থাকলেও, গুরুত্বগত পার্থক্য নেই। কিন্তু আমাদের লাইনে দাঁড়ানোর মানসিকতাটা অন্যরকম। কি করে আগে যাওয়া যায় আরেকজনকে টপকে। যে সেই অভিসন্ধিতে টাকার জোরে, বা বাহুর জোরে, বা চালাকীর জোরে সফল হল; সে তো আমার কাছে ঈর্ষা ও প্রশংসার তুল্য। যে সেটা করতে পারছে না সে মরমে মরছে নিজের দৈন্যতা দেখে। কজন মানুষকে দেখেছি শান্ত মনে নিজের অবস্থানটাকে মর্যাদা দিয়ে অপেক্ষা করতে? বিনা ক্ষোভে বা বিনা হীনমন্যতায়? খুব অল্প সংখ্যক, যাদের আমরা বোকা নীতিবান বলে ঠাট্টা করি।
কথাটা লাইনে দাঁড়ানোর না। কথাটা Short cut খোঁজার এমন জাতীয় মানসিকতা। কোন্ দর্শন একে কি ভাবে ব্যাখা করে জানি না। তবে রেটিনা আর মস্তিস্কের ওপর যে দর্শন প্রতিবিম্বিত হয় সমাজের তাতে মনে হয় না শাসকদল বা বিরোধীদল খন্ডযুদ্ধ আলোচনায় কোনোদিন কোনো সুরাহা বেরোবে।
আমার ব্যক্তিগত প্রয়োজন আমার বেঁচে থাকার মূল তাগিদ। এ সত্য। তবে আংশিক সত্য। আমার প্রয়োজনটাকে আমি যে কোনো উপায়ে মেটাতে চাই এবং তা নৈতিক হল কি না হল দেখার আমার দরকার নেই। এও আংশিক সত্য। কখন বুঝব এ আংশিক সত্য? যখন দেখব আমার ব্যক্তিগত প্রয়োজনগুলো মেটানোর জন্য আমায় সমাজের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে প্রতি মুহুর্তে। খাদ্য, বস্ত্র, পথ, আলো, চিকিৎসা, শিক্ষা সব কিছুতেই আমি সমাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর সেই কাজটাকে যে পথে সুচারুভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব সেটাই হল নীতি। আমি আজ থেকে রাস্তার ডানদিক ধরে হাঁটব ঠিক করলে শুধু আমার না অনেকের অসুবিধা, এর ব্যাখার প্রয়োজন হয় না। ব্যাঙ্ক, স্কুল, অফিস, আদালত যখন তখন যেমন খুশী খুলবে বললে সেটা হাসির কথা হয়ে পড়ে। কারণ তাতে আমার ব্যক্তিগত প্রয়োজনের ক্ষেত্রেই একটা বিষম গোলোযোগ তৈরী হবে। তাই আসলো নিয়ামানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তীতা। কিন্তু এই অনুবর্তনের কাছে যদি মনটা স্বাভাবিকভাবে বাধ্যতা স্বীকার না করে, সব সময় যদি নিজের সুবিধাকেই প্রাধান্য দিতে চায় তখন যে কি অরাজকতার সৃষ্টি হয় তার উদাহরণ চারিদিকে। "ওনাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি তাই কাজ বার করতে অসুবিধা হল না"..."আপনার কেউ পরিচিত আছে গো, বলুন না তা হলে আর বেগ পেতে হয় না"... এধরণের বাক্যের সাথে আমরা জন্মলগ্ন থেকেই পরিচিত।
এর ফলস্বরূপ হল, আমরা সর্বত্রই ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরীতে বেশি আগ্রহী হই। ডাক্তার, উকিল, শিক্ষক, ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, পদস্থ অফিসার, মন্ত্রী, উপমন্ত্রী ইত্যাদি সব আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয়ের মধ্যে হলে নিজেকে নিরাপদ বোধ করি। কারণ নীতির থেকে পরিচিতির জোর বেশি।
জানি না এ চরিত্র আদৌ কোনোদিন বদলাবে কি না। নাকি আমাদের দেশে আরো কাঁড়ি কাঁড়ি মহাপুরুষ জন্মে যাবেন। আর জন্মাবেনই বা না কেন? যে দেশে একজন মানুষকে জ্বলজ্যান্ত চিতায় পোড়ানো বন্ধ করতে বোঝানোর আবশ্যকতা হয়, সে দেশে মহাপুরুষ তো মুড়ি মুড়কির মত আসবেনই। তুমি যত অন্যায় করো, নির্দিষ্ট তিথিতে অমুক যায়গায় স্নান করলেই তুমি শুদ্ধ! ছোটবেলায় একটা গল্প শুনেছিলাম। কার্তিক আর গণেশের মধ্যে নাকি চ্যালেঞ্জ হয়েছিল। যে পুরো পৃথিবীটা আগে ঘুরে আসতে পারবে, সেই জগদম্বার কোলে বসবেন। কার্তিক সারা বিশ্ব ঘুরতে বেরিয়ে গেলেন ময়ূরে চড়ে। ফিরে এসে দেখেন গণেশ মায়ের কোলে বসে। কি করে? কারণ গণেশের কাছে মা-ই সারা বিশ্ব। বোঝো! কি অন্যায় পক্ষপাতিত্ব। শ্রদ্ধা হল গিয়ে অন্তরের ব্যাপার, তাকে এরকমভাবে প্রতিযোগিতার কাজে লাগানো কোন দেশি ন্যায়পরতা? কিন্তু সেই গল্প শুনেই বড় হলাম।
ঘুষ নিতে না পারা, সমাজের অতিরিক্ত সুবিধাগুলো কোনোভাবেই করায়ত্ত না করতে পারার হীনমন্যতায় ভোগা আমরা যতদিন না মান-হুঁশে ফিরছি, ততদিন চলুক এই তর্জা, শাসকদল বনাম বিরোধীদল, আমরা বনাম ওরা, বর্ত্তমান বনাম পুরাতন। কিন্তু খবরদার! কখনোই আঙুলটা নিজের দিকে ঘুরিও না!
সৌরভ ভট্টাচার্য
7 February 2015