আজ কবীরের জন্মতিথি। কবীরের জীবনী, বাণী নিয়ে অনেক কাজ যে হচ্ছে, বা হয়েছে, আমার তা মনে হয় না। আধুনিক ভারতে কবীরকে নিয়ে বোধহয় সিরিয়াসলি ভাবনা চিন্তা শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। হাজারীপ্রসাদ দ্বিভেদীকে কবীরের জীবনী লিখতে অনুপ্রাণিত করা, ক্ষিতিমোহন সেনের মাধ্যমে কবীরের বাণী সংগ্রহ করা, যার কিছু নিয়ে একশোটা কবিতাকে অনুবাদ করা। সব বইগুলোই পাওয়া যায়। এটা অবশ্যই খুব আশার কথা।
কবীর চর্চায় বর্তমান ভারতে অগ্রণী ভূমিকায় আছেন Purushottam Agrawal মহাশয়, যাঁর কবীরের উপর কয়েক বছর আগে বেরোনো ইংরাজি ভাষায় 'কবীর কবীর' নিয়ে লিখেছিলাম, আমায় মুগ্ধ করেছিল। আজ আরেকটা বই প্রকাশিত হতে চলেছে, এই বইটা শ্যামসুন্দরজী'র কবীরের সংকলন, ১৯২৮ সালে প্রকাশিত, পুরষোত্তমজী আবার বইটাকে নতুন করে পরিমার্জিত করে প্রকাশিত করছেন, রাজকমল প্রকাশনী থেকে, হিন্দিতে।
কবীরের দর্শনের ঈশ্বর আর স্পিনোজার দর্শনের ঈশ্বর এক অনেকাংশে। নির্গুণ, নিরাকার। জগতের স্রষ্টা হিসাবে না, তাঁদের দর্শনের মূল হল তিনি এই জগত নিজেই। সর্বস্ব তিনি। স্পিনোজা যেমন সব ধর্মীয় অথোরিটিকে অস্বীকার করেছেন প্রামাণ্য হিসাবে, ঠিক তেমনভাবেই কবীরও। কবীর যেমন ভারতের সাধকদের মধ্যে এক ভিন্ন পঙক্তিতে, স্পিনোজাও পাশ্চাত্যের দার্শনিকদের মধ্যে ভিন্ন পঙক্তির। দু'জনের জীবনই ভীষণ আড়ম্বরহীন, খুব যে আর্থিক আনুকুল্যের মধ্যে তা নয়। একজন তাঁতি, অপরজন চশমার লেন্স সারিয়ে জীবিকা অর্জন করতেন। আরো একটা উল্লেখযোগ্য মিল হল দু'জনকেই সেদিনের ধর্মীয় অথোরিটিরা ব্রাত্য করেছিল। কিন্তু দমাতে পারেনি।
কবীরের মোটামুটি ২৩৪ বছর পর স্পিনোজা জন্মগ্রহণ করেন। দু'জনের অনুভব, বিচারই বলে, সমগ্র এক-এর মধ্যে 'একত্ব'কে অনুভব করাই আসল কথা। সার কথা। সেখানে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। যে কথাটা আবার এই কদিন আগেই গোটা জীবন দিয়ে বলে গেলেন জে কৃষ্ণমূর্তি — Truth is a pathless land. আগল সরাও, অনুভব করো। কোনো অবতার, পুরোহিত, মোল্লা ইত্যাদি কারো মধ্যস্থতা লাগবে না। নিজেকে নিজেই সব রকম মোহ থেকে মুক্ত করো নিজের তাগিদে। নিজের সঙ্কীর্ণতা দূরে সরিয়ে। ইম্যানুয়েল কান্ট একেই পরে বলছেন এনলাইটেনমেন্ট। আশ্চর্য দর্শন নয়, সত্য দর্শন, সত্য বোধে।
কবীর কোনোদিনই ভারতের মণীষায় খুব একটা চর্চিত হননি, দুর্ভাগ্যবশত। উদার মত নিয়ে দল গঠন করা যায় না। যদিও কবীরপন্থী সাধক আছেন, তবুও সে অর্থে ব্যবসাকারী দল পেকে ওঠেনি। কবীর জাতপাত স্বীকার করতেন না, কোনো বইকে সে অর্থে অথোরিটি মানতেন না, সে অর্থে কোনো গুরু, অবতার মানতেন না। কবীর সত্যকে প্রেমের সঙ্গে মিলিয়ে এক-এর সাধন করতে বলতেন। যে সুর লালনের মধ্যে পাই --- সত্য বলো, সুপথে চলো। ভালোবাসা ছাড়া সুপথ হয় নাকি? কবীর বলছেন প্রেমের আড়াই অক্ষরকে জেনে নিলেই তুমি জ্ঞানী। জ্ঞান মানে অনুভবের মাধ্যমে জানা। যে অনুভবের উদ্দেশ্য সবের মধ্যে এক-কে দেখা, এক-এর মধ্যে সবকে দেখা। এক-এর অন্বেষণ - ভালোবাসায়, যুক্তিতে, উদারতায়। অনুভব তোমাকে সে আলোর দিকে নিয়ে যাবে, যুক্তি সমাজের নানা ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে তোমায় রক্ষা করবে, আর উদারতায় ভিন্নতার পাঁচিল ভেঙে মিলনের রাস্তা খুলবে।
বলাবাহুল্য, কবীরেরও শত্রু হয়েছিল বেশ কিছু। সত্যকে সত্যের আলোতে খুঁজলে দলের লোকেদের অসুবিধা হয়। সেদিনও হয়েছিল। হিন্দু-মুসলমান দুই-ই পক্ষের বেশ কিছু মানুষ ভালোভাবে নেননি কবীরকে। তাদের মনে হয়েছিল কবীর সমাজের সমীকরণ নষ্ট করে ভারসাম্য বিঘ্ন করছেন। আজও অনেকের মনে হয়, তথাকথিত নীচু জাতের মানুষ যখন উঁচু কাজের দায়িত্ব পায়। সদ্য দেখা সিনেমা 'কাঁঠাল', হিন্দিতে, নেটফ্লিক্সে, এই নিয়েই।
ধর্মীয় কূটকচালি থেকে সরে এসে চিত্তের অধ্যাত্মবোধকে জাগানোর কথাকে অনেকেই সেদিন শুনেছে, আমল দেয়নি। অনেক অনেক ধর্ম নিয়ে কোন্দল বেঁধেছে তারপরেও। খুব কাছাকাছি যুগে রামকৃষ্ণদেবের কথাকেও খুব একটা সিরিয়াসলি কেউ নিয়েছে বলে মনে হয় না।
রামকৃষ্ণদেব, কবীর প্রমুখ ব্যক্তিদের নিয়ে সমস্যা হল তাঁদের জীবনী আর বাণীর মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। আমাদের থাকে। রামকৃষ্ণদেব, কবীর কোনো ধর্ম, মতবাদ ইত্যাদি 'প্রচার' করেননি, জীবনে যেটাকে সত্য বলে অনুভব করেছেন সেটাকেই সারাটা জীবন দিয়ে যাপন করেছেন। তাই-ই বলে গেছেন, আজীবন। এর পিছনে কোনো মতলব ছিল না। এর আগে একটা সাধন ছিল। যে সাধনের মূল কথা, ভেদ নেই ভাই... ভেদ নেই.... সব ভেদ তোমার মনে। মন আলোকিত করো। সব আলোকিত হবে।
রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৭ সালে, মার্চে, রামকৃষ্ণদেবের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে যে সর্বধর্মসভার আয়োজন করা হয়েছিল রামকৃষ্ণ মিশনের তত্ত্বাবধানে, সেখানে ভাষণ দিতে গিয়ে একদম শেষ পর্বে কবীরকে উল্লেখ করে বলেছিলেন,
"Let me concluded with a few lines from the great mystic poet of medieval India, Kabir, whom I regard as one of the greatest spiritual geniuses of our land:
The jewel is lost in the mud, and all are seeking for it;
Some look for it in the east, and some in the west;
Some in the water and some amongst stones.
But the servant Kabir has appraised it at its true value,
And has wrapped it with care
In a corner of the mantle of his own heart."