সৌরভ ভট্টাচার্য
1 April 2018
(কেউ যেন ব্যক্তিগত ভাবে নিয়েন না, লেখকের কিঞ্চিৎ বায়ুরোগ আছে, মাথায় চড়লে প্রলাপ বকে। এ সেই প্রলাপ)
বাঙালী ভক্তের জাত। বাঙালী হুজুগের ভক্ত। কালী, দূর্গা তো অনেক হল। এরকম পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অমন মেনীমুখো হয়ে থাকলে চলবে না বাপু! বাঙালি অ্যাদ্দিনে বুঝেছে। পুরুষাকার জাগছে। রক্তে অ্যাড্রিনালিনের পরিমাণ বাড়ছে। ওই বোলপুর আর জোড়াসাঁকো করে করে শুকুতে বসেছিল গা!
তো কথা হল, নতুন একটা হুজুগ বাঙালি বহুদিন পর পেলো। ফুটবল, ক্রিকেট বড্ড গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। ঘ্যানঘ্যানে, ম্যাড়মেড়ে। ধুর! আমরা পুরুষ না? অমন রাদ্দিন "ম্যা, ম্যা" করে ডাগলে চলবে? আর ক'দ্দিন জাতটা নাবালক থাকবে, অ্যাঁ!
আর তাই এই নতুন খেলা। তা দেখোনি পুরোনো শুকিয়ে যাওয়া নদীতে হঠাৎ করে বান ডাকলে কেমন নোংরা, পাঁক, মড়া, শুকনো গাছের ডাল ইত্যাদি হুড়মুড় করে ভেসে আসে? এও তেমনি। অ্যাদ্দিনের শুকনো শিরা-ধমনী-স্নায়ুতে একটু ঢেউ খেলছে গো। আর কদ্দিন সেই রোবিন্দনাথ, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, জীবনানন্দ নিয়ে হেদিয়ে মরবি বাপ! ও সব তো শুঁটকিমাছের থেকেও শুকিয়ে ছিবড়ে হয়ে গেছে। আর যা গুটিকতক ফুলের ঘায়ে মূচ্ছো যাওয়া কবি লেখক আছে তাদের দিয়ে কয়েক কিলোমিটার দৌড় করানো যায় না, জোরে কথা বললে হেঁপিয়ে মরে, বইমেলায় হালখাতা খুলে বসে, তাদের দিয়ে কি হবে বাপ! তারা বরং বর্ষা, বসন্ত, পেরেম-টেরেম নিয়ে থাকুক, আর কিছু সেই বস্তাপচা মেয়েদের দাবীটাবি নিয়ে শখের লড়াই করুক। আমরা নামি আসল লড়াইতে।
আরে ভাই নরম মেরুদণ্ড যেদিকে বাঁকাবি সেদিকেই বেঁকবে। আমরা বলি 'ফ্লেক্সিবিলিটি'। নিন্দুকেরা বলে 'নীতিহীনতা'। তা মোদ্দা কথাটা তো বাপ এক, নরম সরম থাকা, যাতে যেদিকে খুশী ঝুঁকে পড়তে অসুবিধা না হয়। জলের মত রং। যে রঙ ঢালবে, তাতেই মজবে।
আসলে দীর্ঘদিন বাঙালী মাটির স্পর্শ হারিয়েছে। তার শিরায়-উপশিরায়, চলনে বলনে - শুচিতা, কৃত্রিমতা, অনুকরণ, দায়হীন গড্ডালিকা প্রবাহের ঢল চলছে। বাইরে চকচকালে হবে কি, ভিতরে ভিতরে যে শাঁস হারিয়ে বাজারি পুরে কাজ চলছে মেলা দিন ধরে। তার সাথে অতীত গৌরবের জন্য উন্নাসিকতার খেসারৎ তো দিতেই হবে। দিতে হচ্ছেও। মেড়ো, বিহারী, উড়ে - অসংস্কৃত, অমার্জিত ইত্যাদি মনোভাব কি কম দিন পোষণ করেছি? তাচ্ছিল্যই বা কি কম করেছি? মনে করেছিলাম, অতীতের সেই প্রস্রবণে বাকি ভবিষ্যত কালটা অমনই কেটে যাবে। তাই যায়? টিকে থাকার সংগ্রামে নিত্য নিজেকে নতুন করে যোগ্যতার পরীক্ষা দিতে হয়, এগিয়ে আসতে হয়। আসিনি তো। না পেরেছি অতীতের মান রাখতে, না পেরেছি দ্রুত পরিবর্তনশীল জড়বিশ্বটার সাথে তাল রাখতে। অগত্যা যা ঘটার তাই ঘটছে। সত্যের মূল্যে যা অর্জন করতে হয়, তাকে সস্তা ভাণে পাব মনে করেছিলাম। আজ চড়া সুদে সে ঋণ শোধ করতে হচ্ছে। লজ্জায় মরে যাচ্ছি, কিন্তু কাউকেই দায়ী করতে পারছি না। কেউ কেউ হাস্যকরভাবে "ওরা আমাদের সংস্কৃতি কেড়ে নিল" বলে কান্নার ধুয়ো তুলছি। তাতে পরোক্ষে নিজের গালেই নিজে চুণকালি মাখাচ্ছি।
জানি না কোনদিকে চলেছি। তবে এর আশু কোনো সমাধান আমাদের হাতে আছে বলে মনে হয় না। বাঙালীর প্রাণের গতি এই অপমানে, এই লাঞ্ছনায় আবার জেগে উঠুক। সত্যের মূল্যে নিজের আত্মসম্মান ফিরে পাক - ফাঁকি দিয়ে নয়, সত্যের মূল্যে - এই প্রার্থনা।