Skip to main content

(আদিকাল থেকে আজ অবধি সকল আলোর পথ প্রদর্শকদের চরণে আজ গুরু পূর্ণিমার পূণ্য তিথিতে আমার সশ্রদ্ধ নিবেদন)

মা কে ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে ফিরছি কল্যানী থেকে। সন্ধ্যে হব হব করছে। রাস্তার আলো গুলো জ্বালা হয়ে গেছে। আমি আর মা গাড়ির পিছনের সিটে বসে। তিনি খুবই অসুস্থ।
মা হঠাৎ বললেন, "দেখ বাবু, কাল হয় তো আমি থাকব না। এই আলো গুলো জ্বলবে, এরকমই রাস্তায় লোক হাঁটবে, গাড়ী চলবে - অথচ আমি থাকব না।"
চুপ করে শুনছিলাম। সাময়িক মন খারাপ লাগলেও মায়ের অনুভুতিটায় একটা চিরকালের আক্ষেপ প্রাণে বেজেছিল - "সব থাকবে, অথচ আমি থাকব না!"
কি আকুতি! যে মানুষকে সংসারে দেখেছি প্রতিদিনের নিত্য নৈমিত্তিক কাজে - সাবান থেকে গ্যাস সিলিন্ডার, কাজের লোক থেকে পেপারওলা, আত্মীয়ের বিয়ে থেকে পাড়ার দূর্গাপূজা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে সারাদিন, তার মধ্যে এমন একজন চিরকালের মানুষও থাকতে পারে?
অবাক লেগেছিল। আরো অবাক লেগেছিল, মায়ের গলায় আক্ষেপের থেকে বিস্ময়ের সুরটা বেশি ছিল বলে।
এ আকুতি তো সব কালের সব মানুষের। এর থেকে উত্তরণ ঘটাতেই তো কেউ নিজের মধ্যে ডুবে কেউ বাইরের হাজার নেশায়। একজন প্রশ্নটার চিরকালের উত্তর খুঁজতে, অন্যজন প্রশ্নটাকেই চিরকালের জন্য ঘুম পাড়াতে।
তবে এই প্রথম না। দৈনন্দিন জীবনে এমন অনেকবার হয়েছে, চেনা আটপৌরে মানুষের গলায় শুনেছি চিরকালের সুর। একজন মুচিকে বলতে শুনেছি, "বাবু জুতোতে সামান্য একটা পেরেক ঠুকেও যদি পয়সা নেব, সে পয়সা আমি রাখব কোথায়?" তখন নিজের চোখে জল ধরে রাখা দায়! এত বড় কথাটা সে এত সহজ করে কি ভাবে উপলব্ধি করল। অথচ এর বিপরীত উদাহরণেই আমরা অভ্যস্ত।
এই অসীমের সুর যা সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকবার প্রত্যক্ষ করেছি, ভবিষ্যতেও করব জানি - তাই আমাদের চলার পথের পাথেয়, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা। তাই বিশ্বাস হয় মানুষকে যতটা চিনি বা বুঝি বলে মানি সে তা চাইতেও অনেকখানি বেশি।
সেই জন্যই হয়তো চিরকালের আলোকিত মানুষদের অনুভুতিকে সত্য বলেই মানি। তাঁদের ভিন্ন গ্রহের জীব বলে মনে হয় না। তাঁরা মানুষের এই দিকটার পরিচয় সারা জীবন সবার মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন বলেই তাঁরা মহাপুরুষ। অনেক ক্ষুদ্র যাঁর মধ্যে আত্মীয়তা লাভ করে, তিনিই তো মহান আত্মা বা মহাত্মা। যেমন বিন্দু বিন্দু জল মিশে থাকে মহাসাগরে। তিনি নিজেকে মহান বলে জেনেছিলেন বলে তিনি মহাত্মা নন, আমাকে - আমাদের মত শত সহস্র মানুষকে মহান বলে জেনেছিলেন বলে তিনি মহাপুরূষ।
স্বামীজী যখন বলছেন, "তোমরা যাকে ভুল করে মানুষ বলো, আমি তাকেই ঈশ্বর বলে ডেকেছি।" এ কাব্য নয়। এ ওঁর কাছে জ্বলন্ত বাস্তব। যীশু যখন বলছেন, "এরা কি করছে জানে না, এদের ক্ষমা করো পিতা", তখন তিনি তাদের হত্যাকারী দেখছেন না, দেখছেন মহিমান্বিত মানুষ হিসাবে। হ্যাঁ তখনো। তাই বুদ্ধ নি:সংশয়ে বলতে পারেন, "আত্মদীপ ভবো", অর্থাৎ নিজেই নিজের আলো হও।কি বিশ্বাস তাঁর আমার ভালোত্বের প্রতি! আসলে এঁরা কেউই নিজের সাথে অন্যের ভেদ দেখতে পাননি বলেই সংসারকে সীমা টেনে খন্ড করে দেখা এঁদের দ্বারা সম্ভব হয় নি। সব কে দেখেছেন একের মধ্যে। তাই নিজেকেও পেয়েছেন সবের মধ্যেই।
আমরাও তাঁদের সামনে দাঁড়ালে সেই অনুভুতির কিছুটা কিরণ পাই, তাতেই ধন্য আমাদের জীবন।
জানি বা না জানি, আমার মধ্যেও একজন চিরকালের মানুষ আছেন। বিশ্বের নিকৃষ্টতম পাপও যাঁর জ্যোতিকে তিল মাত্র হ্রাস করতে পারে না। সুযোগ পেলেই হুহু করে জ্বলে ওঠে সে তেজ। সংসার পায় আরেকজন অঙ্গুরীমালকে, আরেকজন ধর্মাশোককে।
তাই বলছিলাম প্রতিদিনের জীবন থেকে নিজের প্রতি, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেললে কে আমায় রক্ষা করবে? মহতের পায়ে শরণ নেওয়ার অন্তিম যোগ্যতাটুকুও যে হারিয়ে ফেলব! জীবন যে বিষাক্ত হয়ে উঠবে!
গুরুদেবের এই প্রার্থনা প্রতিদিন একটু একটু করে আমার জীবনে সত্য হয়ে উঠুক,

"আমার পরান-বীণায়
ঘুমিয়ে আছে অমৃতগান--
তার নাইকো বাণী, নাইকো ছন্দ,
নাইকো তান।
তারে আনন্দের এই জাগরণী ছুঁই'য়ে দাও।"