যুক্তিবুদ্ধির পাশাপাশি, একজন খেয়ালি মানুষও থাকবে। সেটাই স্বাভাবিক। যুক্তিবুদ্ধির নিয়ম আছে। খেয়ালের একটা ধর্ম আছে। সে খেলতে ভালোবাসে। সে বিশ্বাস করে। কল্পনা করে। ভয়কে সৃষ্টি করে, ভয়কে ভাঙে। এ সব খেয়ালেরই খেলা।
আমাদের সমাজ রাতদিন বলছে, ওই খেয়ালি মানুষটাকে বেঁধে আনো। আমি উপঢৌকন দেব। তোমায় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ভরিয়ে দেব। খেয়াল তোমায় কী দেবে? হয় তো বা শেষে গোটা জীবনটাই নষ্ট হবে! তার চাইতে এসো, একটা সুরক্ষিত জীবনযাপন করো। খেয়ালকে একটা বারান্দা ছেড়ে দাও। যে বারান্দায় দশদিকে দশটা সিসিটিভি ক্যামেরা লাগাও। কড়া পাহারায় রেখে, খেয়ালকে বলো, এই তো দিলাম জায়গা, খেলে বেড়াও।
========
যুক্তিবুদ্ধির নিয়মমাফিক সফলতা এলে মানুষের মধ্যে যে গর্ব জন্মায়, সে গর্বকে অনুভব করতে একটা সমাজ লাগে। সমাজ মানে ঈর্ষা করতে পারে এমন প্রতিবেশী অন্তত লাগে কয়েকজন। সামাজিক সফলতার বোধের সঙ্গে প্রতিবেশীর ঈর্ষার একটা যোগসূত্র আছে। সে কাউকে ছোটো না করে, কাউকে বশে না এনে নিজেকে সফল ভাবতে পারে না। অনেকাংশেই পারে না।
কিন্তু খেয়ালের সে দায় নেই। সে যদি গভীর জঙ্গলেও থাকে তবু সে নিজের আনন্দের সামগ্রী খুঁজে নেয়। হয় তো খেলার সাথীর না পেয়ে মন তার মাঝে মাঝে কেঁদে উঠতে পারে। কিন্তু খেয়াল নিজেই নিজের রাজা। নিজেই নিজের প্রজা।
======
আমাদের সমাজে এই খেয়াল বড় উপেক্ষিত। আসলে আমরা একটা বিরাট কল চালাতে চাইছি যার মুনাফা মোটামুটি ন্যায্য-অন্যায্যভাবে ভাগবাটোয়ারা করে সমাজটাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে চাইছি। এখন একটা কলে নিয়ম নিষ্ঠার যে ডাক, সেখানে খেয়াল তো বড় বালাই। কথা বাস্তব, কিন্তু সত্য নয়।
কিন্তু খেয়াল কী এতটাই অকেজো, অবান্তর? মজার কথা হচ্ছে মানুষের আসলে ভালো থাকার সূত্রই এই খেয়ালের মধ্যে রয়েছে। মানুষ সব নিয়ম মেনে নেয়, সব পরাধীনতা স্বীকার করে নেয়, একদিন সে নিজের খেয়াল মত বাঁচবে এই স্বপ্নে।
ক্রমে সে স্বপ্ন যায় হারিয়ে। ভালো থাকার সংজ্ঞা বদলাতে থাকে। নিজের খেয়াল থেকে নিজের দূরত্ব বাড়ে। নিজেকে যত বাঁধে, নিজেকে যত শাসনে রাখে নিজেকে তত সফল মনে করে। গভীরে আত্মার শূন্যতা বাইরের নামযশ, প্রতিপত্তি দিয়ে ভরিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু তা হবে কেন? অবশেষে গ্রাস করে এক বিকার।
======
কিন্তু এই খেয়ালের একটা স্বধর্ম আছে, সেটা মরমী বোঝে। খেয়াল মাত্রেই দিশাহীন খেয়ালিপানা না, যা আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়। এই খেয়ালেরও যে একটা ধর্ম আছে সেটা দেখায় অন্তর্দৃষ্টি। খেয়ালকে যদি অন্যের ক্ষতিতে, অন্যের বিরুদ্ধে না লাগানো যায়, তবে খেয়াল এক মহাসম্পদ। খেয়ালকে যদি নিজের দম্ভের বাঁধন থেকে মুক্তি দিই, তবে খেয়ালও আমাকে নানা ক্ষুদ্রতা থেকে মুক্তি দেয়। খেয়ালের সব চাইতে বড় শত্রু, নকল খেয়াল, যা দম্ভের শরীর থেকে জন্মায়। “আমার ইচ্ছা হয়েছে তাই করেছি, বেশ করেছি”, এই তার ভাষা। খেয়ালের একটা ধর্ম আছে। কিন্তু দম্ভের কোনো ধর্ম নেই।
দম্ভ আর খেয়াল একসঙ্গে থাকতে পারে না। দম্ভ তার কাজ হাসিলের জন্য বুদ্ধির চাতুরী আর খেয়ালের স্বভাবসিদ্ধ সাহসকে কাজে লাগাতে চায়। কিন্তু শেষে নিজের জালে নিজেই আটকায় বুদ্ধি আর খেয়ালকে দূষিত করে।
======
শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, ঈশ্বরদর্শন হলে তার স্বভাব পাঁচ বছরের বালকের মত হয়ে যায়। অর্থাৎ তার দম্ভ থাকে না। থাকে খেয়াল। তার খেলা। কবি যখন “খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে” গানে “বিরাট শিশু” র কল্পনা করেন, সেও এক দম্ভহীন সত্তার কল্পনাই করেন।
সমস্ত ধর্মে ঈশ্বরের যে শুদ্ধ ধারণা আছে, সে দম্ভহীন এক দরদী, সর্বশক্তিমান, আনন্দময় সত্তার। দম্ভকে সরিয়ে প্রজ্ঞা আর করুণায় মানুষের জীবনকে সার্থক করার কথা বলেন বুদ্ধ। এ করুণাও খেয়ালের ধর্ম থেকে জন্মায়। নইলে সুপরিকল্পিত করুণা বলে কিছু সোনার পাথরবাটির মত অবাস্তব একটা কথা হয়ে দাঁড়ায়।
এখন এই দম্ভহীন হওয়ার শিক্ষা কি কাউকে দেওয়া যায়? না। তবে যে কোনো সৎ শিক্ষাই অবশেষে মানুষকে এই জায়গায় নিয়ে আসে - মানুষের প্রকৃতির ইতিহাস তাই বলে। দম্ভকে জানাই দম্ভকে নাশের একমাত্র উপায়। বাকি সব দম্ভনাশের উপায় দম্ভেরই নানা ছদ্মবেশ মাত্র।
খেয়াল যদি মুক্তি পায়, তবেই আমি মুক্ত। আর খেয়াল যদি দমবন্ধ অনুভব করে, তবে আমিও বন্ধ। ভীষণভাবে বদ্ধ।