সৌরভ ভট্টাচার্য
14 February 2020
ভালোবাসা নিয়ে লেখার একটা ছুতো পেলে এমনি এমনিই যেতে দেব নাকি? কক্ষণও না। সে লোকে যতই বলুক ক্লিশে, যতই ব্যঙ্গ করুক, জ্ঞান দিক – ভালোবাসা তো রোজকার দিনের, আমি তবু লিখব। যদি বলো সব কথা কি ভালোবাসা নিয়ে এখনও লেখা হয়ে যায়নি? আমি বলব, হয়ে গেলেও আমি লিখব। তাদের লেখার উপর দাগ বোলাবো, তবু লিখব। কেউ যদি বলে এ ভালোবাসা তো আসলে কাম, বিশুদ্ধ কাম। আমি বলব, যে মাটির প্রদীপে শিখা জ্বালাতে জানে না, সেই বলে এ কথা। আমি বলি না, যদিও আস্তাকুঁড়েতে অনেক শিখাহীন প্রদীপের লজ্জা দেখেছি। সে কথা থাক। শিখার কথাই বলার আজ।
ভালোবাসা যেন এলেবেলে। তা নিয়ে বিপ্লব হয় না। তা নিয়ে আন্দোলন হয় না। তা নিয়ে বাজেট পেশ হয় না। কিন্তু তাকে নিয়ে আগ্রহেরও শেষ নেই, আবার ছুঁৎমার্গীদের হাজার-একটা বায়নাক্কারও শেষ নেই। যত নিয়ম-নীতি-ভয় মানুষের যেন ওই একটা শব্দে। সমস্ত জগৎ যেন উচ্ছন্নে যাচ্ছে ওই একটা শব্দে। অথচ এই একটা শব্দের অভাবে যে কত প্রাণ শুকিয়ে মরছে, পচে মরছে শুধু এই বিধিনিষেধগুলোর শিকলটার ভার গায়ের থেকে নামাতে পারছে না বলে, তার খেয়াল আছে? শরীরটার জুজু এমন দেখিয়ে রাখা হয়েছে, যেন পান থেকে চুন খসলেই শরীর ভালোবাসার রাজ্যে ঢুকে একটা হুলুস্থুল কাণ্ড বাধাবে, আর যত পবিত্র ভালোবাসার ফল টুপটুপ করে মাটিতে পড়ে নষ্ট হবে, পুরো সমাজ মুহূর্তে ধ্বংস হবে।
সত্যিই কি তাই? মানুষী ভালোবাসায় এমন অসুরের মত শরীরের খিদে? বাকি যে ভালোবাসাটুকুকে আমরা সমাজস্বীকৃত ভালোবাসা বলি, হয় সে অনুকম্পা, নয় বাৎসল্য, নয় ভক্তি, আর বাকিটুকু আইনের স্বাক্ষর নিয়ে শরীরী হওয়ার অনুমতি। এর বাইরে ভালোবাসা গেলেই যেন সুনামি। আজও মধ্যযুগের ভালোবাসার শাসন বাজারে বাজারে বিক্রি হচ্ছে। মেয়েরা কামিনী, মেয়েরা লজ্জাভূষণাবৃতা, মেয়েরা সমস্ত সমাজের ঢাল, মেয়েরা দুই তীর – মধ্যে বয়ে যাচ্ছে উন্মত্ত পুরুষী কাম ইত্যাদি ইত্যাদি। সমস্ত শুচিতা শরীর নিয়ে, সমস্ত শাসন শরীর নিয়ে, সমস্ত ধর্ম শরীর নিয়ে, সমস্ত নীতিনিয়ম শরীর নিয়ে – এ সবের মিলিত ফল কি? একটা ভণ্ডামিতে ভরা, নিষ্প্রাণ, অনুকরণ পুনারবর্তনে বাঁচা সমাজ। শরীরকে এত ভয় কেন? কারণ একটাই, ভালোবাসা নেই বলে। একটা গাড়ি যদি দুর্গম পাহাড়ি পথে ওঠে, তবে ক্ষণে ক্ষণে খাদে পড়ার ভয় সেই পায় যার চালক দুর্বল, খাদের আকর্ষণ না, খাদের ভয় তাকে খাদের দিকে নিয়ে যায় বলে। আমি এখনও দেখেছি যে বাড়িতে যত নানা গুরুর আধিপত্য সে বাড়ির বাচ্চাগুলোর মনে তত বিকার, তত অপরিণত বিকৃত ভাবনা-চিন্তার বিষফল।
যখন স্কুলে পড়ি তখন আমার এক সহপাঠী ছিল যাদের পরিবার রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষিত। আমি তার মুখে শুনতাম কিভাবে নারী পুরুষকে তার উৎকর্ষতা থেকে বিপথগামী করে। তারপর কলেজে উঠে শুনলাম আমার এক বৈষ্ণব সহপাঠীর মুখে যে নারী নরকের দ্বার। ধীরে ধীরে বুঝলাম, নারী হয় মা, নয় মাগী। এর মাঝখানে ধর্মীয় বিশ্বাস শ্বাস নিতে পারে না। ধর্মের এত শরীরী ভয়। এত সঙ্কোচ। এতেই নাকি সমাজ টিকে থাকবে, এতেই নাকি মঙ্গল। আমার বলতে লজ্জা থাকলেও, দ্বিধা নেই, স্কুলে পড়াকালীন এ বিশ্বাস আমার মনেও দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। আমিও মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত উন্নাসিক পৌরুষের গর্ব অনুভব করতাম – নারী হয় ত্যাগের সিঁড়ি, নয় ভোগের রাজ্য, হয় ভক্তিমতী, হয় সেবিকা, নয় অবিদ্যা, নয় রাক্ষুসী, নয় কুলক্ষণা। এ-ও আমাদের মহান আদর্শের শিক্ষা, যতই বাইপাস করার চেষ্টা করা হোক না কেন, যতই নানা মোড়কে আজকে ঢাকার চেষ্টা করা হোক না কেন।
এ প্রথার সাথে লড়াইয়ে অবশ্যই সারদাদেবী আর নিবেদিতার অবদান অনস্বীকার্য। কোনো ধর্মীয় উন্মাদনা নয়, কোনো অবাস্তব তত্ত্বকথার মোড়ক নয়, শুধুমাত্র মানবিকতাই এদের যুক্তির সাক্ষ্য। একটা উদাহরণই যথেষ্ট মনে করি --- একজন মহিলা কাঁদছেন পাগলের মত, কারণ তার উপপতি তাকে ছেড়ে চলে গেছে। যার সাথে সে নিজের সংসার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল। আমি আগেও বলেছি বেশিরভাগ শরীরীশুচিবাই, সঙ্কীর্ণমনা, জীবনে সব উৎসাহ হারানো দুর্বল মানুষগুলো ধর্মের রাজ্যে ঢোকে, শ্রীঅরবিন্দ যেমন বলতেন, যখনই মানুষকে বলি ঈশ্বরের কাছে সব সমর্পণ করো, সে আগেই নিজের সাধারণ বুদ্ধিটাকে সমর্পণ করে রাখে। সে যা হোক, যখন সেই মহিলার গলাচেরা কান্না বাগবাজারে সারদাদেবীর ঘরে এসে পৌঁছালো তিনি উঠে গিয়ে সিঁড়িতে দাঁড়ান এবং জিজ্ঞাসা করেন, কি হয়েছে ওর? সবটা শোনেন। ওনার সাথে যে সব আরো তথাকথিত পূর্ববর্ণিত ভক্তিমতীরা ছিল, তারা বলল, বেশ হয়েছে, যেরকম নিজের স্বামীকে ছেড়ে আসা, সেরকম শাস্তিই হয়েছে। এই সিদ্ধান্তে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই অবশ্য, কারণ আজও একই নিদান পেতেন মহিলা, আমি সিরিয়ালগুলোর উপকরণ সম্বন্ধে যতটা জ্ঞাত তার উপর ভিত্তি করে বলতে পারি। কিন্তু সারদাদেবীর মুখ থেকে সেদিন যা বেরিয়েছিল, তা কি করে এক গ্রামে বড় হওয়া, তথাকথিত অশিক্ষিতা মহিলা বলে ওঠেন ভাবলে আজও বিস্মিত হতে হয়। তিনি বলেছিলেন, তোমরা চুপ করো, নির্দয় হয়ো না, যে মানুষটা একজনকে নির্ভর করে সব ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে, তাকে ছেড়ে যাওয়াটা খুব অন্যায় হয়েছে তার।
এ একটা যুগান্তকারী সংলাপ। এর অর্থ এ নয় যে তিনি বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ককে উৎসাহ জানাচ্ছেন বা নৈতিক সমর্থন জানাচ্ছেন, তিনি এইখানে ভালোবাসার পক্ষ নিচ্ছেন, নীতির না। এইখানেই সূত্রপাত হয় মধ্যযুগীয় ভাব থেকে মানবিক বিশ্বাসে নিজের বিচারধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। হ্যাঁ, তথাকথিত এমন একটা অনৈতিক, অসামাজিক ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিতেও তাঁর বাধেনি তখন। বারবার বলতেন, “ভাঙতে সবাই পারে, গড়তে পারে ক'জন? নিন্দা-ঠাট্টা করতে পারে সব্বাই, কিন্তু কি করে যে তাকে ভাল করতে হবে, তা বলতে পারে ক'জনে?”
আর কি করে সে ভালো হয়? “ভালোবাসাতেই সব কিছু হয়, জোর করে কায়দায় ফেলে কাউকে দিয়ে কিচ্ছু করানো যায় না”। আর শেষে সেই মৃত্যুশয্যায় শুয়ে অমোঘ বাণী, “যদি শান্তি চাও, কারও দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপন করে নিতে শেখো। কেউ পর নয়, জগৎ তোমার”। এতদিন তো আমরা শুনেছি জগৎ আমাদের পর, “মন চলো নিজ নিকেতনে, সংসার বিদেশে বিদেশীর বেশে ভ্রম কেন অকারণে”... বিবেকানন্দ গাইছেন, আরোও শুনেছি, “ভেবে দেখ মন কেউ কারো না, মিছে ভ্রম ভূমণ্ডলে”... রামকৃষ্ণ তথা আপামর সাধক গাইছেন। কিন্তু সারদাদেবী একি কথা বললেন? হুম, এই কথাই ভালোবাসার কথা।
মানুষের সমস্ত শুচিবাই তার শুষ্ক হৃদয়ের সাইড এফেক্ট। মা সারদা তা জানতেন। বুঝতেন। পুরো জাতটা হৃদয়টাকে দূরে ফেলে, একে অন্যের দোষ দেখে, নিন্দামন্দ করে, ধুঁকছে, তা-ও বুঝতেন। তাই ওনার এক সঙ্গী যখন শীতের রাতে শুচিবাইতার জন্য গঙ্গাস্নানে যাবেন বলেন, তিনি ধমক দিয়ে বলেন, “সারাদিন জড়ের মত বসে থেকে থেকে কি শুচিবাই মনটাই না তোদের হয়েছে, আমায় ছোঁ, আর স্নানে যেতে হবে না।“ এ অহমিকার কথা না, আত্মবিশ্বাসের কথা।
আর নিবেদিতার কথা? স্বামীজির দিকে তাকিয়ে আছেন মুগ্ধ হয়ে, স্বামীজিকে আসলেই সেদিন দুর্দান্ত দেখাচ্ছিল, স্বামীজি মুচকি হেসে বলেন, দেখো এসব (নিজের শরীরের দিকে আঙুল দেখিয়ে) যেন তোমায় বোকা করে না দেয়!
নিবেদিতা তো সত্যিই স্বামীজিকে ভালোবেসেছিলেন, কিন্তু এই কথাটাকে সহজভাবে মেনে নিতে ভক্তকূল পারবে না বলেই "সেই সময়" এর অসামান্য লেখকের আর ভয়ে স্বামীজির জীবনী লিখতে চেয়েও লিখলেন না। কিন্তু যখন "স্বামীজিকে যেরূপ দেখিয়াছি" বইটা, বা "স্বামীজির সহিত হিমালয়ে" পড়লেই বোঝা যায় মানুষটাকে কি অপরিসীম ভালোবেসেছিলেন মার্গারেট। শ্রীকান্ততে লেখক যখন ইন্দ্রজিতের মনোভাব বালক শ্রীকান্তর মুখ দিয়ে বলাচ্ছেন তখন নিজেই প্রশ্ন করছেন যে পাঠক হয় তো ভাববে যে বালক এমন মনোরাজ্যের গভীরের কথা জানে কি করে? উত্তরও শরৎচন্দ্রই দিচ্ছেন, একমাত্র ভালোবাসলেই হৃদয়ের অন্তঃস্থলে প্রবেশের অধিকার মেলে, সব রহস্য উন্মোচিত হয়। এ কথা স্বামীজির শিষ্যদের সাথে একান্ত কাটানো সময়েও "দেববানী" বইতে উল্লেখ আছে - "প্রেমিকের কাছেই সব রহস্যের দ্বার উন্মোচিত"।
ভালোবাসা মানে হলিউড না, ভালোবাসা মানে বলিউড না, পার্ক না, আউটিং না – আবার এগুলোর সবক'টা থাকলেও আপত্তি নেই, শুধু এগুলো হলেই আপত্তি। ভালোবাসা মানে নিজেকে প্রতিদিন সব জড়তা থেকে বাঁচিয়ে নতুন হয়ে ওঠা – "তোমায় নতুন করে পাব বলে হারাই ক্ষণে-ক্ষণ, ও মোর ভালোবাসার ধন।" সে ভালোবাসায় শরীর খাদ হয়ে সারাদিন আতঙ্কে রাখে না। সেখানে শরীর থেকে হৃদয় --- কেউ তার সামঞ্জস্য হারায় না বলেই কোনো বিকার হয় না। ভালোবাসা সঞ্জীবনী হয়ে ওঠে। ভালোবাসাকে কোনো সংজ্ঞায় বাঁধতে চাও কেন দুর্বল? ভালোবাসা সাকার থেকে নিরাকারের দিকে যাত্রা। নীড় থেকে আকাশে ডানা মেলা। তুমি আকাশ কেড়ে নীড়ে শেকল পরে আর যাই হোক মরে বেঁচে থাকতে পারো, বেঁচে থেকে মরতে পারো না।