Skip to main content
 
 
মাঝে মাঝেই একটা কথা পড়ছি, তবে তো সেই বিজ্ঞানের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হল। ধর্ম কি দিল? সব তো মিথ্যা, ফক্কা, ধাপ্পাবাজ বেরোলো।
       এই দুটো কথাই অর্ধসত্য। আজ এত এত মানুষ, এত এত অসুবিধার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, অপেক্ষা করছে, আশা করে পথ চেয়ে আছে একটা কিছু সুরাহা বেরোবে। এইটাই ধর্ম। এইটাই মানুষের জীবন্ত ধর্ম। এইটাই সেই ধর্ম যাকে আমরা বলি, যা ধারণ করে থাকে তাই ধর্ম। এই তিতিক্ষা, এই সহনশীলতা - একদিনে, এক মুহূর্তে লাভ করা যায় না। একে যতটা সহজলভ্য মনে হয়, আদতে তা নয়। রামকৃষ্ণদেব বলতেন তুমি যতই পাখিকে রাম-কৃষ্ণ-হরি ইত্যাদি নাম বলার অভ্যাস করাও না কেন, শেষে গিয়ে যেই না বেড়াল ধরবে তখনই সে ট্যাঁ ট্যাঁ করবে। তুলসীদাস বলছেন ধর্মলাভের সত্য পরীক্ষা হয় দুঃসময়ে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে - রোগে, শোকে, দারিদ্রে। সেই সময়ে কতটা সহনশীল তুমি? কতটা তিতিক্ষাবান? সেই হল আদতে আসল ধর্মের পরীক্ষা।
       গীতা বলেন, যিনি সহনশীল তিনি অমৃতের অধিকারী। এ কোন অমৃত? নিশ্চয় নশ্বর শরীরের কথা ভেবে যুদ্ধক্ষেত্রে বলেননি। বলেছেন নিজের চিত্তের স্থৈর্যশক্তির কথা ভেবে। কি করে বলছি? কারণ সমস্ত গীতা জুড়ে সমচিত্ততার জয়গান। চিত্তের সাম্য যেন নষ্ট না হয়ে যায় সেই জয়গান।
 
       শিরডির যিনি সাঁইবাবা, সারাটা জীবন একটা শিক্ষার কথাই বলে গেলেন, শ্রদ্ধা ও ধৈর্য। ওনার ভাষায় শ্রদ্ধা ও সবুরী। সেই সহনশীলতার কথা। রামকৃষ্ণদেব বলতেন, যে সয় সেই রয়। বলতেন, দেখো না, বাংলা বর্ণমালার মধ্যে '' তিনটে - স, , ষ। ওনার অনুপম উপমার কৌশল। তাই বলছেন, দেখো তিনটে স মানে আসলে ওই সহ্যের উপরেই জোর। সহ্য করতে হবে। সহনশীল হতেই হবে।
       সেকালের বুদ্ধ বলছেন, আর একালের মা সারদা বলছেন, সহ্যের সমান গুণ নেই।
       এই সহনশীলতাটুকুই ধর্ম। বাকিটা শুধু তার বহিরাঙ্গ। যেটুকু ভালো কথা, যেটুকু ভালো শিক্ষা, যেটুকু ভালো নীতি - সব এই একটা অভ্যাসের উপরেই - সহনশীলতা। তবে আমাকে কোনো ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে হবে? এও এক গোলমেলে প্রশ্ন। ঈশ্বরের বোধ চেতনার গতির সাথে সাথে বদলে যেতে থাকে। আবার রামকৃষ্ণদেবের ভাষায়, যদ্দিন অজ্ঞান, তদ্দিন ওই ওই, আর যেই জ্ঞান হল, তখন এই এই।
       এ সব কি কঠিন কথা? না, যে পরিস্থিতি দিয়ে আমরা যাচ্ছি তার চাইতে কঠিন কথা না। যে লক্ষাধিক মানুষ আজ এই পরিস্থিতে প্রায় ভাঁড়ার শূন্য অবস্থায় দিন গুনছে, যে মানুষগুলো তাদের কাছে নিঃশব্দে সাহায্যের তাগিদ নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে, তারা সবাই জানে এটা খুব একটা কঠিন কথা না। এইটাই বাস্তব। নইলে এতদিনে গোটা পৃথিবীতে মানুষ নামক জীবটি এত অসাম্য, এত অবিচার, এত অন্যায়ের মধ্যে কবে নিজেরাই কাটাকাটি করে শেষ হয়ে যেত। হয়নি। হবেও না। এই ভাইরাসেও পৃথিবী জনশূন্য হবে না। কিন্তু ধর্মের এই পাঠটা সব্বাইকে একবার ঝালিয়ে নিতেই হল। ভ্যাকসিন আজ না হয় কাল বেরোবেই। সেই দিন অবধি, তার সাধারণের নাগালগম্য হওয়া অবধি এবং তারপরেও নানা অসাম্যের মধ্যে চিত্তের স্থিরতার কাজটা করে যেতে যে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে যাবে, সেই হল ধর্ম। কাণ্টের ভাষায় ক্যাটাগোরিক্যাল ইম্পারেটিভ। থিওরি অব জাস্টিসের লেখকের ভাষায় ন্যায্যতার প্রতি ঝোঁক, সবের মূল ওই এক, দক্ষিণেশ্বরের প্রজ্ঞাবান মানুষটির ভাষায় - নাহং, নাহং, তুঁহু, তুঁহু।
       আমি আমি নই, তুমি তুমি। এই সহনশীলতা জন্মায় যেদিকে তাকিয়ে সেই বৃহতের দিকে, সামনের দিকে, আশার দিকে, তাকাতেই হবে। এ ছাড়া সম্বল নেই। বাকি সব বহিরঙ্গ।