সৌরভ ভট্টাচার্য
23 November 2020
যা কিছু জেনেছি, সে আমার বাস্তব। যা জানি না, সে আমার অনুমান। হাসপাতালে যখন যাই, নানা রোগে আক্রান্ত মানুষের কষ্ট আমার জানার মধ্যে পড়ে না, কারণ আমি চিকিৎসক নই, তাদের কষ্ট আমার জানার মধ্যে পড়ে না, কারণ আমি সে রোগে আক্রান্ত নই। রুগীর প্রতি আমার সহানুভূতি জন্মাতে পারে, আবার না-ও পারে। আবার ভয়ও জন্মায় – আমার যদি হয়?
ভয়, আতঙ্ক, কুন্ঠা, সংশয় – সব এই অজানা, অস্পষ্ট জানাকে নিয়ে। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য যিনি আসবেন বাবার দেখাশোনা করতে তিনি মুসলমান। মনে সংশয়, সে কেমন? কেউ কেউ সহজ হিসাব টেনে ফেললেন, “মুসলমান মানেই হয় তো কোনোভাবে সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত হবে, সারা পৃথিবীতেই তাই! এই একটি ধর্ম না থাকলে পৃথিবীটা কত শান্তির হত ভাবুন! কত ধ্বংস, কত আতঙ্ক, কত সন্ত্রাস শুধু এই একটি ধর্মের জন্য। আপনি বৌদ্ধ, খ্রীষ্ট ইত্যাদি ধর্মানুলম্বী মানুষের দিকে তাকান, এরকম ভয়ংকর নয়।“
থামিয়ে বললাম, কিন্তু দুটো বিশ্বযুদ্ধ?
তিনি বললেন, “থামুন তো মশায়, সে দুটো রাজনৈতিক জটিলতা। তারপর থেকে আর হয়েছে? হয়নি তো। হব হব করেও হয়নি। তবে? আসলে এই সহজ সত্যটা আপনারা মানতে পারেন না। দেখুন দুটো প্রতিবেশী দেশ নিজেদেরকে কিরকম ইসলামিক বলে ঘোষণা করেছে, মানে আত্মপরিচয় দিয়েছে যে তাদের আগে ধর্ম পরে বাদবাকি যা কিছু। মানে ধর্মের পরিচয়ে আত্মপরিচয়, ওসব সেক্যুলারিজমের ভণ্ডামি ওরা রাখেনি। এরা সব ওখানে গিয়ে থাকলেই পারে, আমাদের এখানে থাকার তো কোনো দরকার দেখি না। আজ অবশ্য আমরা যোগ্য জবাব দিতে শিখেছি। দেখুন না ওই সব CAA আইন চালু হলে কি হয়।“
কথা থামালাম। আসলে এই যে আক্রোশ, এর মূলেও সেই অজানা। আমরা পাশাপাশি থেকেও নিজেদেরকে চিনতে শিখিনি। এ কথা মহাত্মা থেকে রবীন্দ্রনাথ প্রত্যেকে জোর দিয়ে বলেছেন, আমরা গায়ে মাখিনি। আমাদের অনেকেরই মুসলমান পরবগুলোর সম্বন্ধে অজ্ঞ বা ভাসা ভাসা ধারণা। তা কেন? কেন আমাদের আগ্রহ জন্মায়নি আমাদের প্রতিবেশীর ধর্মকে ভালো করে জানার বা বোঝার? আমাদের তাদের সম্বন্ধে অস্পষ্ট ধারণা ভয় আর আতঙ্কের জন্ম দিয়ে চলেছে। আজ ‘লাভ জিহাদ’ বলে যে শব্দটা শুনছি সে আসলে ভয়জাত দুর্বলতার শব্দ। যে কয়েকটা বিজ্ঞাপন নিয়ে খুব আলোড়ন হল সে আমাদের অজ্ঞতার পরিচায়ক।
যাকে অল্প জানি তাকে একমাত্রায় জানি। যেমন একদিন আমাদের সম্বন্ধে কি সব সাংঘাতিক ধারণা ছিল পাশ্চাত্যের! আমাদের সমগ্র সাহিত্য নাকি তাদের লাইব্রেরীর একটা তাকও সম্পূর্ণ করার যোগ্যতা রাখে না। আমাদের নীতি নেই, ধর্ম নেই, ভাষা নেই, দর্শন নেই, আভিজাত্য নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। ম্যাকুলে, জেমস্ মিল প্রমুখ ব্যক্তিরা এই ধারণাকে উস্কানি দিয়ে দিয়ে আরো বাড়িয়ে তুলেছিল। ভারত নাকি সব অলৌকিক সাধুতে ভর্তি, মেয়েদের জন্মের পরেই আমরা সমুদ্রে নিক্ষেপ করি ইত্যাদি ইত্যাদি সে কত গল্প!
কিন্তু তাদের সেই অজ্ঞতা ঘোচে যত আমাদের মধ্যে জ্ঞানের বিনিময় হয়। ম্যাক্স মুলার, এডুইন আর্নল্ড প্রমুখ নানা মানুষের আন্তরিক অন্বেষনে নিবেদিতা, পণ্ডিচেরীর শ্রীমা প্রমুখ মানুষের ভারতের মাটিতে আত্মদানে; ক্রমে বিবেকানন্দ, গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের লেখায়, চরিত্রে সে অন্ধকার ঘোচে। ভারতের সম্বন্ধে তাদের ধারণা অস্বচ্ছ থেকে স্বচ্ছ হয়। তারা যদি আগের ধারণাকেই আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইত, তারা যদি তাদের সন্দেহের ভ্রূকুটিকেই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইত, তবে তো কোনোভাবে আমাদের মধ্যে যাতায়াতের যোগাযোগের পথটা সুগম হত না। আমরা একে অন্যকে ভয় পেতাম, দূরত্ব রেখে বাঁচতাম। যেমন এক সময় সমস্ত আমেরিকানকে শুধু বুর্জোয়া, পুঁজিবাদী আর শ্রমিকের রক্তশোষকের দৃষ্টিতে দেখার খেলায় মেতেছিলাম। আজ সে খেলা নেই। এখন সত্যকে, বাস্তবকে ভালোয়-মন্দ'য় মিশিয়ে দেখতে শিখেছি।
এই একমাত্রিক জানায় কোনোদিন কোনো মঙ্গল নেই। যেমন বাংলার বাইরে কোনো সাহিত্য রচনা হয় না তেমন, এও এক ধারণা ছিল, আজও অনেকের মনে সে ধারণা আছে। বাংলা সিনেমার বাইরে কোনো সিনেমা সে অর্থে ক্ল্যাসিক নয়। বাংলায় যা লেখা সবই ক্ল্যাসিক হয় কি? বাংলায় যা সিনেমা বানানো হয় সবই কি সেই উচ্চমানের? এ সব ধারণাই একমাত্রিক ধারণার ফল। উড়িষ্যা মানেই দুর্ভিক্ষ; বিহার মানেই নোংরা, শাসনহীনতা; দক্ষিণ ভারত মানেই শুধু ইডলি-ধোসা রাতদিনের খাওয়া; আফ্রিকা মানেই শুধু জঙ্গল আর সিলেবাসের বাইরের জন্তু-জানোয়ার, গাছপালা; ডিটেকটিভ মানেই ছিপছিপে শরীর, সংসারের আর সব বিষয়ে উদাসীন শুধু অপরাধী খোঁজা মানুষ --- এরকম আরো আরো কত যে আছে তা বলে শেষ হবে না। এই অল্প জানা, অস্পষ্ট জানায় কোথাও দোষের পরিমাণ অল্প, কোথাও বেশি। ইদানীং মার্কেণ্ডেয় কাটজু কিছু অজ্ঞাত কারণে তার এই একদেশী আলোচনায় সারা ভারতের বিরাগভাজন হয়ে চলেছেন সে আমাদের অনেকেরই জানা হয় তো।
দোষ আমাদের অনেক। আমরা দু'পক্ষই আমাদের নিজেদের চিনতে চেষ্টা করিনি। আজও করি না। আমার দেশে যদি নদী আর মরুভূমি দুই-ই থাকে, তবে দুটো পথের সম্বন্ধেই আমার সম্যক জ্ঞান থাকা কাম্য। গীতার জ্ঞান যদি থাকে তবে কোরাণের জ্ঞান থাকাও বাঞ্ছনীয়। একদিন আমাদের এক বৃহৎ শ্রেণীর মানুষকে আমরা আমাদের ধর্মগ্রন্থগুলো পড়তে দিইনি, এবং তাদের সেই অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র তাদের যথেচ্ছ নিপীড়ন শোষণ করে এসেছে, আজও কয়েকটি রাজ্যে তা হয়ে চলেছে। এর থেকে বেরোনোর উপায় অবশ্যই শিক্ষা। কিন্তু মস্তিষ্কের শিক্ষা আর চিত্তের শিক্ষা এক পথে হয় না। আমাদের সমস্ত শিক্ষাই মস্তিষ্কের শিক্ষা, আমাদের বুদ্ধিকে, আমাদের তথ্যের ভাণ্ডারকে শাণিত, সমৃদ্ধ করার শিক্ষা। কিন্তু ভর ও শক্তির নিত্যতা সূত্র জানলে আমার চিত্তের অন্ধকার তো দূর হয় না। চিত্তের অন্ধকার দূর হয় মানুষকে জানলে। একটা সভ্যতাকে জানলে, একটা সংস্কৃতিকে জানলে। নিজের চোখে না, তাদের চোখে।
সদ্য ছটপুজো হয়ে গেল। সমস্ত বাঙালির উল্লাস দেখলাম সরোবরে তারা নামেনি, ঠেকিয়ে রাখা গেছে, এই মর্মে। এর মধ্যে একটা আমরা-ওরা বিভাজন আছে। কাউকে দেখলাম না যারা বাড়ির উঠানে কিম্বা টবে দাঁড়িয়ে, কিম্বা কৃত্রিম জলাশয় বানিয়ে তাদের আচারটা পালন করছেন তাদের প্রশংসায় তেমন কিছু বলতে। তারা যেন সেটা বাধ্য হয়েছেন করতে। আর আমরা যে কম কম পুজোতে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছি সেটায় যেন পুলিশের তৎপরতার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সচেতনতার উদযাপনও ছিল।
ইদানীং আমেরিকায় কয়েকজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষ প্রশাসনের উচ্চবিভাগে স্থান পেয়েছেন। সারা ভারতে সেই নিয়ে কি প্রবল উচ্ছ্বাস! কিন্তু কয়েক দশক আগে যখন এক বিদেশী বংশোদ্ভূত মানুষের ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা উঠেছিল সারা দেশ জুড়ে কি বিদ্বেষমূলক কথার ঢেউ উঠতে দেখেছিলাম! যদিও আমেরিকায় কমলা হ্যারিসের ভারতীয় হওয়ার যোগসূত্র থাকা সত্ত্বেও তাদের দেশের আত্মগরিমায় কোনো আঘাত আসতে পারে ভেবে কোনো আলোড়ন আমার অন্তত চোখে পড়েনি এখনও।
আমাদের বিদ্বেষের একটি মূল কথা হল অস্পষ্ট জানা, অল্প জানা। আর একটা ছোটো উদাহরণ দিয়ে এ লেখা শেষ করি। একটা অনুষ্ঠানের রিহার্সাল হচ্ছে, রামকৃষ্ণের জন্মমহোৎসবের উৎসব। আমিও আছি। যার বাড়িতে হচ্ছে সে বাড়ির সবাই অনুকূল ঠাকুরের ওখানে দীক্ষিত। ওনাদের একটি নির্দিষ্ট সময়ে প্রার্থনার রীতি আছে। রিহার্সাল বন্ধ হল। তারা সবাই তাদের প্রার্থনায় যোগ দিতে গেলেন, অবশ্যই পরিবারের সবাই, আর বাকি রামকৃষ্ণ ভক্তকূলকে দেখলাম আড্ডায় মত্ত হতে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনারা যাবেন না? তারা কেউ খানিক তাচ্ছিল্য, খানিক উদাসীনতা ইত্যাদি মিলিয়ে বললেন, কেন? আমি নিজে গিয়েছিলাম। তারপর ওনাদের সেই তাচ্ছিল্যের ভাবই আমায় বাধ্য করল অনুকূল ঠাকুর সম্বন্ধে পড়তে। পড়তে গিয়ে দেখলাম অনেক মতের সঙ্গে আমি সহমত না হলেও এমন অনেক কথাই আছে যাকে তাচ্ছিল্য করার মত নয়। কিন্তু সে আলোচনার জায়গাটা এটা নয়। কারোর বিরুদ্ধে আক্রোশ, তাচ্ছিল্য, ভুল ধারণা – ইত্যাদি শুধুই তাকে পরিপূর্ণভাবে না জানার ফল। অজ্ঞতা।
আজ সেই অজ্ঞতার প্রাচীরে বারুদ জমা হচ্ছে। ভয়টা সেখানে। এ বারুদ শুধু যে প্রাচীরের একদিকে ফাটল ধরাবে আর বাকি দিককে অক্ষত রাখবে এমন ধারণা করা বাতুলতা। এ অজ্ঞতাকে নাশ করতেই হবে। ধর্মের অজ্ঞতা ধর্মের সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান থেকেই দূরীভূত হয়। আমরা আমাদের যেন জানতে চেষ্টা করি, গ্রহণ করতে চেষ্টা করি। যত বুঝব, তত কাছাকাছি আসব। আমি জানব সে আমার বিপরীতে নেই, সে আমার থেকে ভিন্নতায় আছে। ভিন্নতাকে জানার মধ্যে নিজের ব্যাপ্তি, নিজের প্রসার। নইলে সঙ্কীর্ণ আর সঙ্কুচিত হতে থাকলে আমাদের দুই পক্ষেরই বিপদ। খ্রীষ্টধর্মের উৎসবকে যেমন ঘরের উৎসব করে তুলেছি, তেমনভাবে শিখ, বৌদ্ধ, মুসলমান ধর্মের উৎসবকে পারিনি। পারিনি, কারণ জানি না বলে। যদি জানি তবে সে উৎসবে যোগ দিতে আমারও কোনো বাধা থাকবে না। একমাত্র সেই পথেই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখি। নইলে বারুদ জমাকে ঠেকিয়ে রাখা দায়।