Skip to main content
 
 
 

"Gandhi was inevitable. If humanity is to progress, Gandhi is inescapable... We may ignore him at our own risk."
~ Dr. Martin Luther King, Jr.


      ভারতের মানুষ একজন সম্পূর্ণ নিখুঁত মানুষ চায়। চিরকাল চায়। কারণ ভারতের মানুষ স্তবস্তুতি করতে ভালোবাসে। তাই সে এমন একজন মানুষ চায় – যে সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত, যার উদ্দেশ্যে সে একটা নিষ্কন্টক স্তব রচনা করতে পারে, আবেগমথিত হৃদয়ে গাইতে পারে। তাই সব পুরাণের মধ্যে স্তবের এত আতিশয্য। ভক্ত স্তব গাইছেন, ভগবান তুষ্ট হয়ে তাদের মনস্কামনা পূরণ করছেন এ উদাহরণ ছড়াছড়ি। এ অত্যন্ত সরল, নিষ্পাপ একটি চাওয়া – আপত্তি নেই। কিন্তু অপরিণত মানুষের চাওয়া।

      এই জন্যেই ভারতে এত অবতারের আগমন বারবার ঘটেছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে হয়ত বা। পৌরাণিক যুগের অবতার থেকে মধ্যযুগ হয়ে আধুনিক যুগেও নানা অবতারে পুষ্ট আমাদের সমাজ। তারা আমাদের জন্য সম্পূর্ণ, নির্ভুল, নিষ্কলঙ্ক। মঠে-মিশনে-আশ্রমে ভিড়ে ঘাটতি পড়েনি। আজও নানা স্তব রচনা হয়ে চলেছে, ভক্তগণ দলে দলে সেই জোয়ারে গা ভাসিয়ে নিজেদের মোক্ষের দিকে নিয়ে চলেছে।

      এখানে মূলে আরেকটা কথা আছে। গীতায় আছে, যখনই ধর্মের গ্লানি হবে, অধর্মের উত্থান হবে, তখনই ভগবান আসবেন, সব ঠিক করে দেবেন। অর্থাৎ, আমাদের কোনো ভূমিকা নেই কিছুতেই। আমরা চোখ বন্ধ করে, হাত জোড় করে তপস্যাটুকু করে গেলেই আমাদের দিক থেকে দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে।

      মহাত্মা এই পরীক্ষায় উতরলেন না। কারণ, সম্পূর্ণ জীবনটা শুধু না, সমস্ত চিন্তাগুলোও সবার সমক্ষে রাখতে চাইতেন। রেখেছেনও। 'ব্যক্তিগত' বলে কোনো শব্দে তাঁর ঘোর আপত্তি। “He exposed even the innermost personal thoughts which individuals usually regard as private. In nearly a half-century of profile writing, speaking, and subjecting his ideas to the test of actions, he painted a detailed self-portrait of his mind, heart, and soul.” – Louis Fischer

      আড়াল না থাকলে মহাপুরুষ হওয়া যায়, ঈশ্বর হওয়া যায় না। আর মহাপুরুষকে চিনতে হলে নিজের মধ্যে “মহান” শব্দের উপর আস্থা থাকতে হয়, ঈশ্বরকে চিনতে হলে কিছু অলৌকিকত্বের উপাদানই যথেষ্ট। তাই আমাদের সব অবতারদের ঘিরে কোনো না কোনো অলৌকিক উপাখ্যান আছেই, সে যতই সূক্ষ্ম ইন্টেলেকচ্যুয়াল হোক না কেন। গান্ধী সেই তকমাটা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন, কোনো আড়াল রাখতে চাননি। এইবারের ‘দেশ’ পত্রিকায় শ্রদ্ধেয় হোসেনুর রহমানের একটা প্রবন্ধ আছে – মহাত্মাকে নিয়ে। রহমান মহাশয়ের পায়ের কাছে আমি আমার কলেজ জীবনে গিয়ে বসে থেকেছি, ওনার নানা বিষয়ে প্রজ্ঞাপূত কথায় প্রাণে আরাম পেয়েছি। বহুদিন পরে ওনার লেখা পড়তে পড়তে মনে হয়েছে যেন সেই কণ্ঠস্বরটা আবার কানে বাজছে। উনি লিখছেন, “গাঁধী হয়তো আমাদের কাছে বড় বেশি করে চেয়ে ফেলেছিলেন”।

      হ্যাঁ চেয়েছিলেন। স্তবকার চাননি, সাথী চেয়েছিলেন। সহযাত্রী চেয়েছিলেন। একটা সিনেমা দেখছিলাম, Article 15, সেখানে একটা সংলাপ আছে, “আমি সেই মানুষটার অপেক্ষায় আছি যে হিরোর অপেক্ষায় বসে থাকে না।“ কথাটা প্রাণে বেজেছে। আমাদের সমাজে অনেক ব্যধি। সে ব্যধি থেকে সরাবার জন্য পথে নামতে হবে আমাদেরই। উপকরণ জোগাড় নেই তা নয়, হাতগুলো দ্বিধাগ্রস্থ – পাছে ভুল হয়। “শিব গড়তে বাঁদর গড়ব নাকি”? তাই শিবও গড়া হয় না, বাঁদরও না। তাল তাল মাটি হাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে অবতারের অবতরণের অপেক্ষায় দিন কাটায়।

      মহাত্মা তা চাননি। তাঁকে যখন কেউ কেউ কৃষ্ণের অবতার হিসাবে দেখতে চাইছেন তখন কঠিন ভাষায় তাকে নিরস্ত করছেন। আমরা কিন্তু তা চাই না, আমরা হয় ঈশ্বর বানাব, নয় দানব। মহাত্মার সামনে বারবার তাই সুভাষ, আম্বেদকর, রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি মানুষের ফেস্টুন টাঙিয়ে তুল্যমূল্য বিচার করতে হয় আমাদের। আমার করুণা হয় সেই মানুষগুলোর জন্য যারা একটা নিখুঁত মানুষ খুঁজতে বেরোয়। এমন নিখুঁত যা তারা নাকি কল্পনাও করতে পারে না। অথবা তাদের নিজেদের মত নিখুঁত নির্ভুল। ও না, তা হবে কি করে? তারা তো সব সাধারণ মানুষ। এই “সাধারণ মানুষ” পদটায় মানুষ নিজেদের যে কত শয়তানি, দুষ্টুমি ঢাকে তার ইয়ত্তা নেই। তাকে সর্বক্ষণ নিজের মধ্যে এই বোধটা জাগিয়ে রাখতে হয় যে তার কপটতা, নীচতা, ঈর্ষাপরায়ণতা, স্বার্থপরতা, কর্তব্যভীরূতা, ইত্যাদি সব এই “সাধারণ মানুষ” শব্দটার নীচে চাপা পড়ে ক্ষমাযোগ্য, চলনসই হয়ে উঠল। “His (Mahatma) greatness lay in doing what everybody could do but doesn’t” এই কথাটা লুইস ফিশার মহাত্মার সাথে এক সপ্তাহ তাঁর আশ্রমে কাটিয়ে লিখছেন।

      মহাত্মা সম্বন্ধে আইনস্টাইন, রোমা রোঁলা, মার্টিন লুথার কিং ইত্যাদি নানা অগ্রগামী মানুষ বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে কি কি বলেছেন সে বারবার শুনেছি। তাতে নতুন করে কিছু মনে হয়নি। কিন্তু আজ এই মানুষ বিশ্বপ্রকৃতি আর তার নিজের মানবিক প্রকৃতিকে নিয়ে যে ঘোর সংকটে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে এ স্পষ্ট যে মহাত্মার প্রদর্শিত দর্শন ছাড়া আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন। “অহিংসা” একটা বাণী কেবল নয়, মহাত্মার কাছে সত্য উপলব্ধির পথ। আমাদের একসাথে বাঁচতে গেলে আজ – একটা সত্যাগ্রহ দরকার। আর কোনো দর্শন না। সব দর্শন বড় অমানবিক, শুষ্ক যুক্তি-নির্ভর, বৌদ্ধিক উত্তেজনা ছাড়া আর কিছু নয়। সব আছে, কিন্তু জীবন নেই। আমাদের আজ দর্শনের থেকে বেশি কিছু চাই, রাজনীতি থেকে বেশি কিছু চাই। আমাদের আজ এক সম্পূর্ণ মানবাত্মাকে আহ্বান জানানোর উপায় চাই। আমাদের বড় দুর্দিন। আমরা “উচিত”কে কবে “স্ব-ইচ্ছা” করে গড়ে তুলতে পারব? কবে আমরা বলতে পারব, আমাদের মনুষ্যত্ব আমাদের সব চাইতে বড় সম্পদ। আমাদের স্বাধীনতাবোধের সাথে দায়-দায়িত্ববোধ কবে যোগ হবে? কবে বুঝব বিশ্ব-বিধানের সাথে নিজেকে মিলিয়ে নিয়ে চলাই স্বাধীনতা। যা মিলতে সাহায্য না করে, যা নিজেকে কিম্ভূত-বিচ্ছিন্ন করে রাখে, সে খণ্ড পরিচয়ে আমার অহং বাঁচে কুয়াশার মত, আমি না।

      বুদ্ধিকে নির্মোহ, নিরপেক্ষ আর চিত্তকে অনুকম্পাযুক্ত রাখতে পারলে আমাদের আর কোন কৌশলের প্রয়োজন হয়? মহাত্মা ধর্মকে অস্বীকার করেননি। ধর্মকে সত্য আর অহিংসায় অনুবাদ করেছেন। বিশ্বের কেন্দ্রে এক উদার অনুকম্পাময় প্রেরণাশক্তিকে বলেছেন – রাম। তিনি রামের জন্মভূমিকে ইঞ্চিতে মাপেননি, চিত্তের কোমলতায় পেয়েছেন। রাম নামকে শান্তির দূত করেছেন, বহুর মধ্যে একের আনন্দে – “এক রাম, হাজারো নাম।“

      আমার মত অতি তুচ্ছ একজন মানুষের পক্ষে মহাত্মাকে নিয়ে বলার ক্ষমতা রাখা সম্ভব নয়। তবু তিনি মহাত্মা বলেই এ স্পর্ধা আমার, মার্জনা করে নেবেন। একদিন জীবনে এক প্রচণ্ড অন্ধকার ঘনিয়েছিল। ভীষণ দুর্দিন সেদিন। সদ্য আঠারোর দোরগোড়ায় জীবন, নানা সংশয়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন মস্তিষ্কের সবকটি কোষ যেন। সব কিছু ভীষণ মেকি, অর্থহীন লাগছিল। সেই সময়ে হাতে এসে পড়েছিল মহাত্মার আত্মজীবনী। মোড় ঘুরেছিল জীবনের। উপরে ওঠার নয়, নীচে নামার, নিজেকে শূন্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। তারপর থেকে আজ অবধি ঝড়ঝাপটা আসেনি তা তো নয়, বিচলিত করেছে, বিভ্রান্ত করতে পারেনি। সেদিন থেকে আজ অবধি মহাত্মাকে আরো জানতে বুঝতে যা যা পেয়েছি পড়েছি, তবু আমার মহাত্মা জিজ্ঞাসা থামেনি। নানা দর্শন, ধর্ম, মত, নীতি ইত্যাদি জানছি, কিন্তু বেঁচে থাকার মত এর থেকে উৎকৃষ্ট পথ আমার মত একজন মানুষের জন্য আর কি হতে পারে আমি পাইনি। আমাদের আজ দর্শন, রাজনীতি ইত্যাদি সব কিছুর বেশি কিছু চাই। মানুষের কথা চাই। আমার চারপাশের সাথে নিজেকে মিলিয়ে নিতে আর যুক্তি ও ভাবের মধ্যে সংহতি স্থাপন করতে আমাদের আর কোনো অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, অলৌকিক প্রত্যাশার প্রয়োজন যেন হয় না। মন-বাক্য-শরীরের ঐকতানে আপনিই নিজের মধ্যে শান্তি আসে। শান্তি থেকে জন্মায় আনন্দ। সে ঐকতানকে পূর্ণতা দিতে জানি এ জীবনে সক্ষম হব না। তবু যতটা চেষ্টা করা যায়। সহিষ্ণুতা শব্দটা মহাত্মা পছন্দ করতেন না, তবু এর বাইরে কোনো শব্দ নেই বলেই বারবার মনে করাতেন, এই সহিষ্ণুতার শক্তিতেই আমাদের উদারতা। আমাদের জাতীয়তাবোধই হোক, কি আত্মবোধই হোক, সে যেন হিংসামুক্ত হয়। বলতেন শান্তি কোনো গন্তব্য না, শান্তিই হল পথ, সত্যই হল ঈশ্বর।

      আমার বারবার মনে হয়েছে, তাঁকে সব মিলিয়ে আমাদের জানা উচিৎ, ওনার জন্য না, আমাদের নিজেদের জন্য। সুস্থ একটা পরিবেশ আর মনের ব্যবস্থা আনার জন্য। খুব সুক্ষ্ম বিচারের দরকার নেই। তিনি একজন ভুলভ্রান্তিমুক্ত নয় এমন একজন মানুষ, যিনি নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে ভালোবাসতে চেয়েছিলেন, মৃদুস্বরে বলতে চেয়েছিলেন ভালোবাসার থেকে বড় শক্তি আমি জানি না। আমি ত্রুটিমুক্ত নই, কিন্তু আমার উপলব্ধি নিয়ে আমার কোনো সংশয় নেই, আমি নাও পারতে পারি, তুমি খানিক চেষ্টা করে দেখো, বলো, চোখের বদলে চোখ হলে এ পৃথিবী অন্ধ হয়ে যাবে একদিন। সত্য ও অহিংসা আমার আবিষ্কার নয়, এ তত্ত্ব হিমালয়ের চেয়ে প্রাচীন, আমি প্রয়াস করেছি মাত্র এ সত্যকে নিজের জীবনে প্রতিফলিত করার। আমি বলিনি তো আমি মহাত্মা, আমি নিখুঁত, আমি চড় খেতে গাল বাড়িয়েছি, বোকা বলে নয়, আমি মানুষকে ভয় পেতে ভুলেছি বলে, মানুষকে ভালোবাসতে গিয়ে বুঝেছি, নম্রতা দুর্বলের সজ্জা না, বীরের সাম্য বেশ।

      শেষ করি রাণা চট্টোপাধ্যায়ের 'মহাত্মা গান্ধী' কবিতাটি দিয়ে,

মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে আমি কখোনো
                  তেমন ক'রে ভাবিনি
একটিও কবিতা লিখিনি কোনোদিন
মনে হয়েচে নেতাজীকে যিনি হারিয়ে দিতে চেয়েছিলেন
যার ভূমিকা বাঙালি বিপ্লবীদের বিষয়ে
খুব একটা সমর্থনযোগ্য ছিল না
তিনি যত বড়ই মহামানব হোন
আমার কিছু এসে যায় না।

তবু তাঁর আত্মজীবনী পড়েছি মন দিয়ে
পড়েছি দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনি
কিভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রায় একাই
                        সংগ্রাম করেছেন
কি মমতায় অন্ত্যজ ও নিম্নকোটিদের
বুকে টেনে নিয়ে বলেছেন 'হরি-জন'।
শুনিয়েছেন 'ঈশ্বর-আল্লা তেরে নাম
                  সব কো সম্মতি দে ভগবান'।

তাঁর সত্যাগ্রহ, ডাণ্ডি অভিযান, 'ভারত ছাড়ো-
                      ইংরেজ' আন্দোলনগুলি
সারা ভারতকে তোলপাড় করেছিল,
এমনকি দাঙ্গার সময় নোয়াখালি
বা ভারত ভাঙ্গার মুহূর্তে বেলেঘাটায় থাকা
আমার জানা ছিল
তবু তাঁকে নিয়ে কখনো কবিতা লিখিনি।

অথচ জানি তাঁকে নাথুরাম নিষ্ঠুরভাবে
                       হত্যা করেছিল।
তাঁকে নিয়ে নেহেরু-জিন্নার কাজিয়াই
শেষ পর্যন্ত উপমহাদেশকে দুই টুকরো করে,
আর লক্ষ লক্ষ ভিটেমাটি হারানো মানুষ
                   চরম দুর্দিনে তাঁকেই শুধু
অভিশম্পাত করেছে। (যেমন আমরা ঈশ্বরকে করি বিনা দোষে)

আজ যতদিন যাচ্ছে বুঝতে পারছি
তিনি যিশু বা বুদ্ধের মতোন একজন
                       মহান মানব ছিলেন
তাঁর অহিংসা নীতির কোন বিকল্প নেই।
সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসার তুলনা
হয়তো একমাত্র চৈতন্যদেবের সঙ্গেই করা যায়।
রবীন্দ্রনাথ তাঁকে মহাত্মা বলেছিলেন;
আজ খুব শান্তভাবে একটি সত্য মেনে নিয়েছি।
বিংশ শতাব্দীর শেষে লেনিন, নেতাজী,
হোচিমিন কিংবা মাও-এর
আগে যদি একটি নামও পৃথিবীর মানুষ
                     খুঁজে পায়
সে নাম অবশ্যই হবে মহাত্মা গান্ধীর।